ইউরোপে বাংলাদেশিদের আশ্রয়ের পথ দিন দিন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। এর বড় কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত, যেখানে বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। এই ঘোষণার পর আশ্রয়ের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে, আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। এর ফলে ইউরোপে নতুন জীবন খুঁজতে আসা বাংলাদেশিদের জন্য আশ্রয় পাওয়া আগের তুলনায় অনেক বেশি জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ ঘোষণা করার পর ইউরোপে আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়ায় বড় পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে একটি আবেদন নিষ্পত্তি হতে দীর্ঘ সময় লাগত, এখন তা দ্রুত সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু এই গতি বাংলাদেশিদের জন্য সুবিধার বদলে অসুবিধা ডেকে এনেছে। অধিকাংশ আবেদনই প্রথম ধাপেই বাতিল হয়ে যাচ্ছে। ফলে যারা সত্যিকারের কারণে আশ্রয় চাইছেন, তারাও শুরুতেই কঠিন বাধার মুখে পড়ছেন। এভাবে আশ্রয় প্রক্রিয়া আগের তুলনায় অনেক বেশি জটিল হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন জটিল হওয়ার পেছনে শুধু নিরাপদ দেশ ঘোষণাই একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে যুক্ত আছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একাংশের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ট্যাক্স ফাঁকি, ভুয়া ব্যবসা খোলা, বিমা প্রতারণা কিংবা ভুয়া নথি দিয়ে আশ্রয় দাবি করার মতো ঘটনা বেড়েছে। এসব কাজ ইউরোপীয় সমাজে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং স্থানীয়দের আস্থা নষ্ট করেছে। ফলাফল হলো—প্রকৃত ভিকটিম বা সত্যিকারের নির্যাতিত মানুষদের আবেদনও গুরুত্ব হারাচ্ছে। তারা প্রয়োজনীয় নথি ও প্রমাণ নিয়েও আশ্রয় পেতে হিমশিম খাচ্ছেন।
ফ্রান্স প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও মাইগ্রেন্টওয়াচ সম্পাদক নিয়াজ মাহমুদ মনে করেন, বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ ঘোষণা কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বার্তা। ইউরোপের কাছে এটি এক ধরনের সতর্ক সংকেত—বাংলাদেশি অভিবাসীরা ধীরে ধীরে বিশ্বাস হারাচ্ছেন।
তার মতে, প্রবাসীদের একাংশের কর্মকাণ্ড ইউরোপীয় সমাজে বিরক্তি ও অবিশ্বাস তৈরি করেছে। ট্যাক্স ফাঁকি, প্রতারণা ও ভুয়া গল্প বানিয়ে আশ্রয় আবেদন করার প্রবণতা বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করেছে। এর ফলে প্রকৃত নির্যাতিত ব্যক্তি, যেমন রাজনৈতিক ভিকটিম, সংখ্যালঘু নাগরিক বা সাংবাদিকও ন্যায়সঙ্গত কারণে আশ্রয় চাইতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন।
তিনি আরও বলেন, এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনা করার। প্রবাসীরা প্রত্যেকেই দেশের অঘোষিত রাষ্ট্রদূত। তাদের আচরণই নির্ধারণ করবে, ভবিষ্যতে ইউরোপে বাংলাদেশির পরিচয় হবে পরিশ্রমী ও বিশ্বাসযোগ্য অভিবাসী নাকি প্রতারণায় জড়ানো ভুয়া গল্পকার।
যদিও বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ ঘোষণা করা হয়েছে, ইউরোপের আদালত স্পষ্ট করেছে যে, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব আবেদন বাতিল করে দেয় না। ব্যক্তিগত ঝুঁকি বা নির্যাতনের শিকার হওয়া মানুষের ক্ষেত্রে আলাদা বিচার করা হবে। অর্থাৎ, প্রত্যেক মামলার ফলাফল নির্ভর করবে ব্যক্তির পরিস্থিতির উপর।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নিরাপদ দেশ ঘোষণার পর থেকে শুরুতেই আবেদন প্রত্যাখানের হার আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এটি প্রমাণ করছে যে, প্রক্রিয়ার জটিলতা বেড়েছে এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আশ্রয় পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইউরোপীয় সীমান্ত ও উপকূলরক্ষী সংস্থা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় এক লাখ অভিবাসী অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকই শীর্ষে রয়েছেন।
সমুদ্রপথে অন্তত আট হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে পৌঁছেছেন। পৌঁছানোর পর তারা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন এবং আশ্রয়ের আবেদন করেন। এই অবৈধ প্রবেশের ঘটনা এবং ভুয়া আবেদনগুলো ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিদের প্রতি সন্দেহ ও কঠোর অবস্থান তৈরি করেছে।
ইতালি প্রবাসী জাতীয় নাগরিক পার্টির সংগঠক মুজাদ্দেদ আল মামুন জানিয়েছেন, প্রতিনিয়ত নতুন বাংলাদেশি অভিবাসীরা ইতালিতে আসছেন। তবে এখন আশ্রয়ের আবেদন প্রথম ধাপেই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাতিল হচ্ছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে আপিলের সুযোগ থাকলেও কিছু ক্ষেত্রেইই আবেদন গ্রহণ হচ্ছে। ইতালির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে কাউকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হয় না।
পর্তুগাল প্রবাসী তরুণ রিফাত শিকদারও একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “একসময় পর্তুগালে সহজেই আশ্রয় পাওয়া যেত। এখন নিয়ম কঠোর হয়ে গেছে। তবে যার আবেদন শক্ত প্রমাণের সঙ্গে, তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।”
প্রবাসীদের এই অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে, যদিও প্রথম ধাপে চ্যালেঞ্জ বেশি, ব্যক্তিগত প্রমাণ ও পরিস্থিতি বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত আশ্রয় পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশকে নিরাপদ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব এখনও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বসম্মত অনুমোদন পায়নি। অনুমোদন পেলে বাংলাদেশিদের আশ্রয় আবেদন দ্রুত প্রত্যাখ্যান করা এবং দেশে ফেরত পাঠানো সহজ হবে।
এ নীতি কার্যকর হলে, সাবেক স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার শাসনামলে সহজে পাওয়া রাজনৈতিক আশ্র্য এখন আর সম্ভব হবে না। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো শঙ্কা প্রকাশ করেছে—বাংলাদেশে এখনও কিছু গোষ্ঠী যেমন বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার রক্ষাকারী ও এলজিবিটিআই সম্প্রদায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাদের জন্য নতুন নীতি অনায্য প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি কেবল প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আচরণের ওপরও একটি সতর্কবার্তা। তাদের দায়িত্ব হলো আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইউরোপের আস্থা ধরে রাখা।