শীতের আবহ শুরু হতেই দেশে বিদ্যুতের চাহিদা চোখে পড়ার মতো কমে এসেছে। দিনের বেলায় চাহিদা নেমে যাচ্ছে আট হাজার মেগাওয়াটেরও নিচে, আর শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবহার আরো কমতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। বিদ্যুৎ ব্যবহারের এই পতনের বিপরীতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) বকেয়া বিল দ্রুত বাড়ছে। স্থানীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চ থেকে নিয়মিত বিল পরিশোধ হচ্ছে না, ফলে বকেয়া এখন ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের স্থাপিত সক্ষমতা ২৮ হাজার ৩৫৯ মেগাওয়াট। গতকাল দিনের বেলায় বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলন ছিল ১০ হাজার ৭১০ মেগাওয়াট, আর রাতের বেলায় ১১ হাজার ৬৭০ মেগাওয়াট। তবে ঘণ্টাভিত্তিক সরবরাহ তথ্য অনুযায়ী ভোর ৫টায় চাহিদা ছিল মাত্র ৭ হাজার ৮৬২ মেগাওয়াট এবং রাত ৯টায় চাহিদা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৯৬০ মেগাওয়াট। এর আগে ১৫ নভেম্বর সকালে চাহিদা নেমে গিয়েছিল ৭ হাজার ৩৫৫ মেগাওয়াটে, আর সন্ধ্যায় তা ছিল প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। সক্ষমতার তুলনায় পিক আওয়ারেও মোট সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। আগামী মাসে শীত আরো বাড়লে গড় চাহিদা সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসতে পারে।
চাহিদা কমে গেলে বিপিডিবির রাজস্ব আয় কমবে এবং বকেয়া পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিপিডিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিল পরিশোধ বন্ধ হয়নি, তবে প্রতি মাসে যে পরিমাণ বিল আসে সে তুলনায় কম পরিশোধ করা হচ্ছে। অর্থ বিভাগ থেকে বরাদ্দের ওপর এ পরিশোধ নির্ভর করে। স্থানীয় কেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ বাড়ানোর চেষ্টাও চলছে।

বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষদিকে কিছুটা গতি আসলেও চলতি বছরের মার্চ থেকে আবার বকেয়া বাড়তে থাকে। বর্তমানে বকেয়া ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহে বড় অংশীদার সামিট গ্রুপের পাওনা বকেয়া বিল ৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার ৯৬০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের পাওনা ৩ হাজার ৪১০ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কেন্দ্রের বকেয়া ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
ইউনাইটেড পাওয়ারের বকেয়া ৩ হাজার ৭৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রের বকেয়া ৫৯০ কোটি টাকা এবং ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রের বকেয়া ২ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা। ইউনাইটেড গ্রুপের হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স মো. শামীম মিয়া জানান, বকেয়া বাড়তে থাকলে আগামী গ্রীষ্মে ময়মনসিংহ অঞ্চলে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জে পড়বে, কারণ জ্বালানি আমদানি ব্যয় পরিশোধে জটিলতা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া ডরিন পাওয়ারের বকেয়া ১ হাজার ৩৭৮ কোটি, কনফিডেন্স পাওয়ারের বকেয়া ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। কয়লাভিত্তিক আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কেন্দ্র এসএস পাওয়ারের বকেয়া প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা, যা গত জুন থেকে জমা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির সিএফও মোহাম্মদ ইবাদত হোসেন ভূঁইয়া জানিয়েছেন, নিয়মিত বিল না পাওয়ায় ইপিসি ঠিকাদার, কয়লা আমদানি ও মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের খরচ পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না।
অন্য বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর বিল বকেয়া রয়েছে আরো অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পায়রার বিসিপিসিএল, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার, ওরিয়ন পাওয়ারসহ ৩০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানের পাওনা রয়েছে। আইপিপি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি মাসে বিপিডিবিকে গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে, মার্চ থেকে বিল বকেয়া হওয়ায় এ অংক এখন ২৫ হাজার কোটি টাকার ওপর দাঁড়িয়েছে। শুধু ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বকেয়া ৬–৭ হাজার কোটি টাকা, আর বাকি অংশ গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বকেয়া।

