দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার কাজিহাল ইউনিয়নের আফিয়া বেগম ২০২৪ সালের শেষের দিকে ৪৪ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। কেমোথেরাপি ও অস্ত্রোপচারের পর তার জন্য প্রয়োজন রেডিওথেরাপি।
স্বল্প খরচে চিকিৎসার আশায় তিনি জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে যান, কিন্তু সেখানে তাকে চার মাস পর সিরিয়াল দেওয়া হয়। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেওয়া তার পক্ষে কঠিন। এত সময় পরে থেরাপি শুরু হলে ক্যান্সার ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও থাকে। আফিয়ার অভিজ্ঞতাকে দেশের ক্যান্সার চিকিৎসার সংকটের প্রতিচ্ছবি বলা হচ্ছে।
রেডিওথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। এটি টিউমার ছোট করতে, ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে এবং উপসর্গ উপশমে উচ্চশক্তির বিকিরণ ব্যবহার করে। একক চিকিৎসা হিসেবে বা অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপির সঙ্গে মিলিয়ে প্রয়োগ করা হয়। ক্যান্সারের ধরণ ও পর্যায় অনুসারে এই চিকিৎসা নির্ধারিত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিছু ক্যান্সার খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা রোগীর শারীরিক অবস্থাকে জটিল করে। রেডিওথেরাপি সাধারণত নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী দেওয়া হয়। প্রতিদিনের বিকিরণ ধারাবাহিকভাবে টিউমারের কোষ দুর্বল করে। সময়মতো চিকিৎসা না দিলে কার্যকারিতা কমে যায় এবং কোষ শক্তি ফিরে পেতে পারে। এতে ক্যান্সার ফিরে আসার বা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা জার্নাল দ্য ল্যানসেটে চলতি বছরে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যে পরিমাণ রেডিওথেরাপি যন্ত্র রয়েছে তা দিয়ে মাত্র ১২.৯ শতাংশ ক্যান্সার রোগী সেবা পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ ৮৭ শতাংশ রোগী রেডিওথেরাপির সুবিধার বাইরে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। শ্রীলঙ্কায় ৪৫.৮%, ভারতে ৪২%, পাকিস্তানে ৩০.৪% এবং নেপালে ২৬.৬% রোগী রেডিওথেরাপি পান।
বগুড়ার টিএমএসএস ক্যান্সার সেন্টারের কনসালট্যান্ট ডা. মো. তৌছিফুর রহমান বলেন, “অধিকাংশ ক্যান্সারেই রেডিওথেরাপি প্রয়োজন। কিন্তু দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ নেই। অল্প কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালেই এটি পাওয়া যায়। প্রাইভেট সেক্টর কিছু উন্নতি করেছে, কিন্তু খরচ বেশি হওয়ায় সব রোগী তা নিতে পারেন না। সরকারি হাসপাতালেও উন্নত প্রযুক্তি কম। সময়মতো থেরাপি না দিলে ঝুঁকি বেড়ে যায়, আর অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ছাড়া পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেশি হয়। সরকারি পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তি নিশ্চিত করা গেলে সাধারণ মানুষ স্বল্প খরচে চিকিৎসা পেতে পারবে।”
দেশে প্রতি বছর নতুন ক্যান্সার রোগীর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি অনুযায়ী প্রতি এক লাখে ১১৪ জন আক্রান্ত হচ্ছেন। এ হিসেবে দেশে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয় এবং প্রায় ৯১ হাজারের বেশি মারা যান। বর্তমানে দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১৩–১৫ লাখের মধ্যে ধরা হচ্ছে। গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি অনুযায়ী, ২০২২ সালে নতুন ১ লাখ ৬৭ হাজার ২৫৭ জন রোগী শনাক্ত হয়, যার মধ্যে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫৯৮ জন মারা যান।
বর্তমানে দেশে ২৪টি হাসপাতালে রেডিওথেরাপির সুবিধা আছে, যার মধ্যে ১৫টি সরকারি এবং ৯টি বেসরকারি। পাশাপাশি দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. আবু হেনা মোস্তফা জামান বলেন, “আমাদের মাত্র দুটি রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে। রোগীর সংখ্যার সঙ্গে মেশিনের সংখ্যা মিলিয়ে অন্তত পাঁচ-সাতটি মেশিন থাকা উচিত। তখন সব রোগী সময়মতো সেবা পাবেন। তবে যন্ত্রের পাশাপাশি দক্ষ জনবলও অপরিহার্য।”

