বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে গেলে মানুষের প্রথম ভরসা এখনো যোগ্য ডাক্তার নয়—বরং এলাকার ফার্মেসি আর দোকানের সেলসম্যান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত হেলথ অ্যান্ড মরবিডিটি স্ট্যাটাস সার্ভে ২০২৫ বলছে, দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ প্রকৃত চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে অদক্ষ সেবাদাতার ওপর নির্ভর করছেন।
সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, রোগী হওয়া মানুষের ৫৪ শতাংশ হয় ফার্মেসির বিক্রেতার পরামর্শে ওষুধ খেয়েছেন, নাহয় নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ওষুধ সেবন করেছেন। সরকারি হাসপাতালে গেছেন মাত্র ১১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ। আর বেসরকারি খাতে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ২০ শতাংশ।
৪৭ হাজারের বেশি পরিবারকে নিয়ে করা এই সমীক্ষা আরও জানায়, দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় মানুষের অসন্তুষ্টি এবং কাঠামোগত সংকট স্পষ্ট হচ্ছে দিনে দিনে।
সাধারণ রোগের তালিকায় শীর্ষে উচ্চ রক্তচাপ
সমীক্ষা বলছে, দেশের সাধারণ রোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে উচ্চ রক্তচাপ—প্রতি হাজারে প্রায় ৭৮ জন এই সমস্যায় ভুগছেন। এর পরেই রয়েছে পেপটিক আলসার, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, চর্মরোগ, হৃদরোগ, হাঁপানি, অস্টিওপোরোসিস, হেপাটাইটিস ও ডায়রিয়া।
গত তিন মাসে প্রতি তিনজনের একজন কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছেন—এতে নারীদের হার সামান্য বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশিক্ষণহীন সেবাদাতার কাছে চিকিৎসা নেওয়ার অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে রোগ শনাক্তে দেরি করায় এবং অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধের অপব্যবহার বাড়ায়।
জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুস শাকুর বলেন, “ওষুধ কোনো জাদুকরী জিনিস নয়। সঠিক ডোজ, সঠিক প্রয়োগ—এসব উপেক্ষা করলে উপকারের বদলে ক্ষতি হয়।”
তিনি জানান, ফার্মেসির পরামর্শে দীর্ঘদিন ব্যথানাশক খেয়ে অনেকে কিডনির ক্ষতি নিজেরাই বাড়িয়ে তুলছেন, অথচ তা বুঝতেই পারেন না।
উচ্চ রক্তচাপে ভয়াবহ ঝুঁকি
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, দেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কের একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগলেও মাত্র ১৬ শতাংশ তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। অর্থাৎ অধিকাংশই হয় রোগ শনাক্ত-বিহীন, চিকিৎসাহীন বা যথাযথ নজরদারির বাইরে।
অনেকেই রক্তচাপ স্থিতিশীল দেখলেই ওষুধ বন্ধ করে দেন—যার ফল হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক কিংবা কিডনি রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাওয়া।
তিনি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করা, নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা এবং কমিউনিটি পর্যায়ে স্ক্রিনিং বাড়ানোর ওপর জোর দেন।
চিকিৎসা ব্যয়েও বাড়ছে মানুষের চাপ
সমীক্ষা জানায়, গত তিন মাসে ব্যক্তিপ্রতি চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ২ হাজার ৪৮৭ টাকা। নারীদের ব্যয় পুরুষদের তুলনায় বেশি—প্রায় ২ হাজার ৫৭৬ টাকা।
সিজারিয়ান হারের ক্ষেত্রেও উদ্বেগ বাড়ছে। ১৫–৪৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে জাতীয় সিজার হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ শতাংশের বেশি। শহরাঞ্চলে এ হার আরও চড়াই।
সন্তান প্রসবে গড়ে ব্যয় হয়েছে ২২ হাজার ৬০০ টাকার মতো; শহরে এই ব্যয় আরও বেশি।
প্রতিবন্ধিতা ও তামাক—দুই সেক্টরেই উদ্বেগ স্থির
দেশের মোট জনসংখ্যার ৫ দশমিক ২ শতাংশ কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতায় ভুগছেন। গ্রামে ও শহরে চিকিৎসা ব্যয়ের পার্থক্যও স্পষ্ট।
এদিকে তামাক ব্যবহার এখনো কমছে না—১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৭ শতাংশ মানুষ এখনো তামাকের ওপর নির্ভরশীল। পুরুষদের হার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
সমীক্ষার চিত্র একটাই বার্তা দেয়—চিকিৎসা পাওয়া, সচেতনতা, প্রতিরোধ—সব ক্ষেত্রেই বড় ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই নীতিগত ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হতে পারে

