গত বছরের রাজনৈতিক পালাবদলের পর কলকাতার হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীদের উপস্থিতি হঠাৎ করেই কমে গিয়েছিল। চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়া হাজারো মানুষের যাত্রা থমকে যায় ভিসা জটিলতা, অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের কারণে। তবে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে সেই চিত্র ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। কলকাতার বেশ কয়েকটি বড় বেসরকারি হাসপাতাল বলছে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোগীর সংখ্যা আবার বাড়ছে—যদিও আগের অবস্থায় এখনো পুরোপুরি ফেরেনি।
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়া আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সবচেয়ে বড় অংশই ছিল বাংলাদেশি। সে বছর প্রায় ৪ লাখ ৮২ হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসা নিতে ভারতে যান, যা আগের বছরের সংখ্যার কাছাকাছিই। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও এই পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে—ভারত, বিশেষ করে কলকাতা, এখনো বাংলাদেশি রোগীদের কাছে প্রধান চিকিৎসা গন্তব্য।
মেডিক্যাল ট্যুরিজম রেটিং সংস্থা কেয়ারএজের হিসাব বলছে, ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশি রোগীদের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই বাংলাদেশি। উন্নত চিকিৎসা, তুলনামূলক কম খরচ এবং ভৌগোলিক নিকটতার কারণেই এই নির্ভরতা দীর্ঘদিনের।
হাসপাতালগুলো কী বলছে
দক্ষিণ কলকাতার রুবি এলাকার রুবি জেনারেল হাসপাতাল জানায়, চলতি বছরের এপ্রিলের পর থেকে বাংলাদেশি রোগীদের যাতায়াত আবার বাড়তে শুরু করেছে। একসময় যেখানে প্রতি মাসে প্রায় ৮০০ বাংলাদেশি রোগী আসতেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার পর সেই সংখ্যা নেমে এসেছিল মাত্র ২০০-তে। বর্তমানে তা বেড়ে প্রায় ৪০০ হলেও আগের অবস্থার তুলনায় এখনো অনেক কম।
হাসপাতালটির অপারেশনস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শুভাশিস দত্ত বলেন, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরতে সময় লাগবে।
মণিপাল গ্রুপের হাসপাতালগুলোতেও একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। গ্রুপটির পূর্বাঞ্চলীয় অপারেশনের দায়িত্বে থাকা অয়নাভ দেবগুপ্ত জানান, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছিল, তা এখন ধীরে ধীরে কমছে। তাঁর ভাষায়, মাসে যেখানে রোগীর সংখ্যা নেমে গিয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৭০০-তে, সেখানে এখন তা বেড়ে গড়ে ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০-তে দাঁড়িয়েছে। এর একটি বড় অংশই নতুন রোগী।
তিনি আরও জানান, পূর্ব ভারতের মণিপাল হাসপাতালগুলোর জন্য প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০০টি মেডিক্যাল ভিসার সুপারিশ দেওয়া হচ্ছে, যা আগের তুলনায় ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
ওপিডিতে রোগী কম, ভর্তি প্রায় নেই
তবে সব হাসপাতালে চিত্র একরকম নয়। বাংলাদেশি রোগীদের কাছে পরিচিত পিয়ারলেস হাসপাতাল জানায়, তাদের বহির্বিভাগে এখন প্রতিদিন মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন বাংলাদেশি রোগী আসছেন। এক বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫০। বর্তমানে বাংলাদেশি রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনাও খুবই কম।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মতে, ভিসা প্রক্রিয়ায় ধীরগতি এর একটি বড় কারণ। পাশাপাশি আরেকটি নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে—টেলিমেডিসিন। অনেক রোগী, বিশেষ করে ফলো-আপ চিকিৎসার ক্ষেত্রে, এখন সরাসরি না গিয়ে অনলাইনে পরামর্শ নিচ্ছেন।
বিপি পোদ্দার হাসপাতালের গ্রুপ উপদেষ্টা সুপ্রিয় চক্রবর্তী বলেন, জরুরি নয়—এমন হৃদরোগ বা আইভিএফ চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীরা এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই চিকিৎসা চালিয়ে নিচ্ছেন। এতে সরাসরি হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন কমে গেছে।
পুরো খাতের ধীরে ঘুরে দাঁড়ানো
বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় মেডিক্যাল ট্যুরিজমকে ঘিরে গড়ে ওঠা পুরো ইকোসিস্টেম—হাসপাতাল, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল ও এয়ারলাইন্স—বড় ধাক্কা খেয়েছিল। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিস্থিতি এখন ধীরে ধীরে স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে।
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাস অনুযায়ী, উন্নত ও সাশ্রয়ী চিকিৎসার কারণে দেশটির মেডিকেল ভ্যালু ট্রাভেল খাত ২০২৬ সালের মধ্যে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি আকার নিতে পারে। আর সেই প্রবৃদ্ধির বড় অংশই আসবে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, কলকাতার হাসপাতালগুলোতে বাংলাদেশি রোগীদের ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গতি ধীর, চ্যালেঞ্জ এখনো আছে, তবে সংকট কাটিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতার পথে হাঁটছে এই নির্ভরতার সম্পর্ক।

