সরকার রাজধানীর নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধন করে আবাসন ব্যবসায়ী ও জমির মালিকদের জন্য বড় ভবন এবং বেশি সংখ্যক ফ্ল্যাট নির্মাণের পথ খোলেছে। সংশোধিত ড্যাপের প্রজ্ঞাপন গত রোববার জারি করেছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২৫-এর প্রজ্ঞাপনও প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালের বিধিমালা অনুযায়ীই নির্মাণ কার্যক্রম চলছিল।
রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে দুই ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। প্রথমত, ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র। এটি দেওয়া হয় ড্যাপ অনুসারে। দ্বিতীয়ত, নির্মাণের অনুমোদন, যা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী দেওয়া হয়। ড্যাপের প্রাচীন নিয়মের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আবাসন খাত শ্লথ ছিল। রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, “সংশোধনের কারণে আমরা আশা করছি, ব্যবসায় গতি ফিরতে শুরু করবে।”
সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ড্যাপ সংশোধন করল। ২০২২ সালের আগস্টে প্রথম ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ীরা সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কিছু সংশোধন আনা হলেও তা ব্যবসায়ী ও জমির মালিকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এরপর বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ড্যাপ সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন সরকার একটি উচ্চপর্যায়ের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী সর্বশেষ সংশোধনী চূড়ান্ত করা হয়েছে।
২০২২-৩৫ সালের জন্য ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের ১,৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি হয়েছে। ড্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০৩৫ সাল পর্যন্ত নগর উন্নয়নের রূপরেখা নির্ধারিত হবে। সংশোধিত ড্যাপে কৃষিজমিতে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে অনুমোদন নিয়ে কৃষিজমিতে পোলট্রি, গবাদিপশুর খাবার, ফিশারি ইত্যাদির জন্য অস্থায়ী অবকাঠামো করা যাবে। এর আগে কৃষিজমিতে মুদিদোকান, ফার্মেসি এবং সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো স্থায়ী স্থাপনা করা যেত, যা এবার আর অনুমোদিত নয়।
ভবনের আয়তন ও ফ্ল্যাট সংখ্যা বাড়ছে:
সরকার ঢাকা মহানগরের নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধন করে আবাসন খাতের গতি বাড়াতে বড় সুযোগ দিয়েছে। সংশোধিত ড্যাপ ও ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২৫-এর প্রজ্ঞাপন গত রোববার জারি হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালের বিধিমালা অনুযায়ীই ভবন নির্মাণ চলছিল।
ড্যাপ সংশোধনের মাধ্যমে ২০ ফুট বা তার বেশি প্রশস্ত সড়কের পাশে আবাসিক ভবনের ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার/ফ্লোর এরিয়া রেশিও) বাড়ানো হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, আগে ২০ ফুট (প্রায় ৬ মিটার) সড়কের ফার ছিল ২.৭৫। এখন এটি ৩.২৫ করা হয়েছে। ৩০ ফুট (৯ মিটার) সড়কের ফার ৩.২৫ থেকে ৩.৫ করা হয়েছে।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এলাকাভিত্তিক ফারও বাড়ানো হয়েছে। পুরান ঢাকা, মগবাজার, শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুর, আফতাবনগর-বনশ্রী, রাজাবাজার, শুক্রাবাদ, পান্থপথ, মিরপুর, বাড্ডা, নিকেতন, বারিধারা সহ ৬৮টি জনঘনত্ব ব্লকে ফার বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও সাঁতারকুলে ফার কিছুটা কমানো হয়েছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, জলসিঁড়িসহ কয়েকটি এলাকার ফার আগের মতো রাখা হয়েছে।
এছাড়া কাঠাপ্রতি আবাসন ইউনিটের হারও বাড়ানো হয়েছে। ফলে ফ্ল্যাটের সংখ্যা বেড়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, পুরান ঢাকায় মূল ড্যাপে আবাসন ইউনিটের হার ছিল ১.২। এখন এটি ২.৪ করা হয়েছে। এর মানে, ৫ কাঠা জমিতে আগে ৬টি ফ্ল্যাট করা যেত, এখন সর্বোচ্চ ১২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা যাবে।
ফার এবং ইউনিটের হার বাড়ানোর কারণে ভবনের আয়তনও বেড়ে যাচ্ছে। মোহাম্মদপুরে ২০ ফুট সড়কের পাশের ৫ কাঠা জমিতে আগে সর্বোচ্চ ৮,২৮০ বর্গফুট আয়তনের ভবন করা যেত, ফ্ল্যাটের সংখ্যা ৯-১০টি। এখন সেই জমিতে ১১,৭০০ বর্গফুট পর্যন্ত ভবন নির্মাণ সম্ভব, ফ্ল্যাট হবে ১১টি। পুরান ঢাকার একই ধরনের ৫ কাঠা জমিতে আগে ৯,৩৬০ বর্গফুট ভবন, ৬টি ফ্ল্যাট করা যেত। এখন ১১,৭০০ বর্গফুট পর্যন্ত ভবন ও সর্বোচ্চ ১২টি ফ্ল্যাট করা যাবে।
গুলশান-বনানী এলাকায় ২০ ফুট সড়কের পাশের ৫ কাঠা জমিতে আগে ৯,৯০০ বর্গফুট ভবন করা যেত, ফ্ল্যাট ৮-৯টি। এখন ১১,৭০০ বর্গফুট ভবন ও ৯-১০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা যাবে। mড্যাপ সংশোধনের ফলে রাজধানীর আবাসন খাতে নতুন গতি আসবে, ভবনের আয়তন ও ফ্ল্যাট সংখ্যা বাড়বে।
ঢাকা মহানগরের নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) সংশোধনের সঙ্গে সঙ্গে ভবন নির্মাণের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ইমারত নির্মাণের নকশা অনুমোদন, আপিল ও মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন ফি আগে ছিল ১ হাজার টাকা। এখন প্রতিবারের জন্য দিতে হবে ৫ হাজার টাকা।
এছাড়া ব্লকভিত্তিক আবাসিক ইউনিট নির্মাণ আবেদনের ক্ষেত্রে প্রতি কাঠায় নতুন করে ৫ হাজার টাকা ফি আরোপ করা হয়েছে, যা আগে ছিল না। আবাসিক ভবন নির্মাণের অনুমোদনের জন্য প্রতি বর্গমিটারে ৫০ টাকা ফি দিতে হবে। বাণিজ্যিক, শিল্পকারখানা ও গুদামের ক্ষেত্রে ফি প্রতি বর্গমিটারে ১৫০ টাকা। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ভবনে মোট ৩ হাজার বর্গমিটার মেঝে এলাকা থাকলে আগে ফি ছিল ২৬ হাজার টাকা, এখন তা বেড়ে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা হবে।
রিহ্যাবের সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, “ড্যাপের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আবাসন খাত শ্লথ ছিল। সংশোধনের ফলে আমরা আশা করছি, ব্যবসায় গতি ফিরতে শুরু করবে। তবে ড্যাপ বাস্তবায়নে যেন নতুন জটিলতা না হয়, সে জন্য আমরা রাজউকের সঙ্গে সহযোগিতা চাইব।”

