জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে ব্যক্তিপর্যায়ে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার উদ্যোগকে এক ধরনের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সন্ত্রাসীদের হাতে থাকা অবৈধ অস্ত্রের তৎপরতা ঠেকানোর লক্ষ্য থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল। বিশেষ করে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে সহস্রাধিক অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। মাঝেমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রার্থীদের অনুকূলে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়াকে ঘিরে সম্ভাব্য প্রভাব ও ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক উত্তেজনা সাধারণত চরমে পৌঁছায়। এমন সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এর মধ্যে বৈধ অস্ত্রধারীদের প্রকাশ্য উপস্থিতি সাধারণ ভোটারদের মধ্যে ভীতি তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ বাড়লে অবৈধ অস্ত্রধারীরাও তাদের তৎপরতা বাড়াতে পারে। এতে সার্বিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। তবে ইতিবাচক দিক হিসেবে কেউ কেউ বলছেন, প্রার্থী বা রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত থাকার সম্ভাবনা থাকবে। এসব ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি মোহাম্মদ নুরুল হুদা গতকাল বলেন, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স সবার জন্য নয়। নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য দেওয়া হয়। সেখানেও যাচাই-বাছাই করা হবে। ফলে অপব্যবহারের আশঙ্কা তুলনামূলকভাবে কম। তিনি বলেন, সব অস্ত্রের মালিক সরকার। সরকার চাইলে যেকোনো সময় অস্ত্র তুলে নিতে পারে। এ কারণে তিনি এ উদ্যোগে বড় কোনো নেতিবাচক দিক দেখছেন না বলে জানান।
তবে ভিন্নমত দিয়েছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক। গতকাল রাতে মুঠোফোনে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় সাধারণত বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া হয়, যাতে নির্বাচনী পরিবেশে কোনো ভীতি না ছড়ায়। সেখানে এই সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রার্থীদের অস্ত্র রাখার লাইসেন্স দেওয়া সরকারের দায়সারা সিদ্ধান্ত বলেই তিনি মনে করেন। তার ভাষায়, প্রার্থী ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। সবার মানসিকতা এক রকম নয়। অস্ত্র ব্যবস্থাপনা ও প্রশিক্ষণের বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই বৈধ অস্ত্রের প্রভাব দেখাতে পারেন। সব মিলিয়ে এই সময়ে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ আর্মস ডিলার্স অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাসির আহমেদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রার্থীদের জন্য যে নীতিমালা জারি হয়েছে, সেটি নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত। তবে ভোটের ফল প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। তিনি বলেন, এত স্বল্প মেয়াদের জন্য লাইসেন্স নিয়ে অস্ত্র কেনা এবং পরে সেগুলো সরকারকে এককালীন ফেরত দেওয়ার বিষয়টি অনেকের জন্য বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। ফলে বিষয়টি ভেবে-চিন্তে এগোবেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগের নীতিমালা আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক হবে। তিনি জানান, সবাই চাইলেই লাইসেন্স পাবেন না। নির্ধারিত যোগ্যতা ও শর্ত কঠোরভাবে যাচাই করা হবে। আবেদন জমা দেওয়ার পর সব প্রক্রিয়া শেষে ১০ দিনের মধ্যে যোগ্য প্রার্থীদের লাইসেন্স দেওয়া হবে। মেয়াদ শেষ হলে সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র থানায় জমা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অস্ত্রের মূল্য বা কোনো অর্থ ফেরত দেওয়া হবে না বলেও তিনি জানান।
এদিকে গতকাল দুপুরে পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের তৃতীয় তলায় ‘এম এইচ আর্মস কোং’ নামে একটি আগ্নেয়াস্ত্রের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, লোহার কেঁচিগেটে একাধিক তালা লাগানো। ভেতর থেকে দোকান পরিচালনা করা হলেও পরিচয় দেওয়ার পর তারা ব্যবসার অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানাতে চাননি। পরে পল্টনের প্রীতম ভবনের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায় ‘শিকার ও শিকারী’, ‘নেহাল ফায়ার আর্মস কোং’, ‘তৈয়ব আলী লস্কর অ্যান্ড সন্স’সহ কয়েকটি অনুমোদিত অস্ত্রের দোকান। তবে সব কটি দোকানই বন্ধ ছিল।
মুঠোফোনে কথা হলে ‘তৈয়ব আলী লস্কর অ্যান্ড সন্স’-এর অন্যতম স্বত্বাধিকারী মিনহাজুল আলম অতুল বলেন, দীর্ঘদিন সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু বন্ধ থাকায় ব্যবসা ভালো নেই। সম্প্রতি রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রার্থীদের জন্য নতুন নীতিমালা জারি হলেও এখনো বৈধ অস্ত্রের কেনাবেচা শুরু হয়নি। সামনে কিছুটা হতে পারে, তবে খুব বেশি আশা করছেন না বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে রিকন্ডিশন্ড বিদেশি পিস্তল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় কেনাবেচা হয়। নতুন বিদেশি পিস্তলের দাম আড়াই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত। শটগানের দাম তুলনামূলকভাবে কম। ব্যক্তিপর্যায়ে এখন পিস্তল ও শটগানের চাহিদাই বেশি বলে জানান তারা।
আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগ নীতিমালা যা বলছে:
জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সংসদ প্রার্থীদের জন্য জারি হওয়া নতুন আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স নীতিমালা বিশ্লেষকরা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন। ১৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এটি প্রকাশিত হয়েছে। নীতিমালার নাম ‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের অনুকূলে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগ নীতিমালা, ২০২৫’।
নীতিমালার মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনী সহিংসতা ও ভয়ভীতি কমানো, রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তিগত সশস্ত্র বাহিনী গঠন প্রতিরোধ করা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। এটি প্রযোজ্য হবে সরকার স্বীকৃত উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং বৈধভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিল ও গৃহীত পদপ্রার্থীদের জন্য।
লাইসেন্স প্রদান করবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ। ‘রিটেইনার’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, প্রার্থী বা রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত অনুমোদিত সশস্ত্র ব্যক্তি। যোগ্যতার শর্তগুলো পূর্বের মতো থাকলেও এক গুরুত্বপূর্ণ শিথিলতা রয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার শর্ত আর বাধ্যতামূলক নয়। এতে প্রার্থীদের জন্য লাইসেন্স প্রক্রিয়া সহজ হবে।
সীমাবদ্ধতার দিক থেকে, লাইসেন্স শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য সীমিত ক্যালিবারের (এনপিবি) অস্ত্রের জন্য দেওয়া হবে। একাধিক অস্ত্র, স্বয়ংক্রিয় বা সামরিক অস্ত্রের লাইসেন্স অনুমোদিত নয়। লাইসেন্স মেয়াদ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার তারিখ থেকে ১৫ দিন। মেয়াদ শেষে লাইসেন্স স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। তবে সব শর্ত পূরণ করলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাময়িক লাইসেন্সকে সাধারণ লাইসেন্সে রূপান্তর করতে পারবে।
নীতিমালায় লাইসেন্সপ্রাপ্তদের আচরণবিধিও স্পষ্ট করা হয়েছে। অস্ত্র বহনের সময় লাইসেন্স ও অনুমোদনপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। ভয়ভীতি বা হয়রানির উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। নিরাপত্তা ছাড়া অন্য কাজে অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ। লাইসেন্স বা অস্ত্র হস্তান্তরযোগ্য নয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশ মানা বাধ্যতামূলক।
যে কোনো অপব্যবহার, নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন বা সরকারের বিধি ভঙ্গ করলে লাইসেন্স ও রিটেইনার অনুমোদন তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল করা যাবে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনের সময় এমন নীতিমালা রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে এটি জটিলতা তৈরি করতে পারে।

