বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরেই নানা অনিয়ম ও সমস্যায় জর্জরিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই সংকট এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে, আর ১৫টি ব্যাংক টিকে থাকার জন্য লড়াই চালাচ্ছে।
অনাদায়ী ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধি, পর্যাপ্ত প্রভিশনের ঘাটতি, দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং শিথিল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য ভয়াবহভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যাপক লুটপাট ব্যাংক খাতকে আরও ভঙ্গুর করে তুলেছে। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের, অনেকে তাদের আমানত সময়মতো তুলতে পারছেন না। কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক কেবল নামে মাত্র টিকে আছে।
সাম্প্রতিক সময়ের তথ্য বলছে, দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে যেখানে বলা হয়েছিল খেলাপি ঋণ ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং মোট ঋণের ৩০–৪০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, সেখানে সর্বশেষ পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরছে।
২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশে। এর পর মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে, জুন ২০২৫-এ খেলাপি ঋণের অঙ্ক প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকাতে পৌঁছেছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গোপন বা আড়ালে রাখা খেলাপি ঋণ যুক্ত হলে এই অঙ্ক ৯ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত ছুঁয়ে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিও বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) বলছে, খেলাপি ঋণের এই ধরনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার দেশের তালিকায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে মোট ঋণ প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে প্রায় ১১ লাখ কোটি টাকাই সমস্যাগ্রস্ত ঋণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। এই অবস্থায় ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়ার পথে চলে গেছে, যারা আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। আরও ১৫টি ব্যাংক মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, যাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রতিষ্ঠান সরাসরি লুটপাটের শিকার।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন অভূতপূর্ব সংকটের মুখে। একদিকে লাগামহীন লুটপাট ও অর্থপাচার, অন্যদিকে কার্যকর সংস্কারের অভাব, সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী, খেলাপি ঋণের দৌরাত্ম্য রোধ করা না গেলে পুরো অর্থনীতিই বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অস্থিতিশীলতা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তত ৫টি বেসরকারি ব্যাংক বর্তমানে কোনোমতে টিকে আছে, ১২টি ব্যাংক কার্যত দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে এবং আরও ১৫টি ব্যাংক অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র জানাচ্ছে, এর মধ্যে অন্তত ১০টি ব্যাংক ইতোমধ্যেই প্রযুক্তিগতভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
এই অবস্থায় খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ জুন ২০২৫ নাগাদ প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা গোপন খেলাপি ঋণ যোগ করলে ৯লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো, যেগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক প্রভাব, অব্যবস্থাপনা ও অস্বচ্ছ ঋণ বিতরণ চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাই উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক, এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট তথ্য বলছে, এই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪৮ শতাংশ থেকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভয়াবহ সংকেত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের সংকট শুধু ব্যাংক খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর প্রভাব পড়ছে সাধারণ আমানতকারীর আস্থা, বিনিয়োগ পরিবেশ এবং পুরো অর্থনীতির স্থিতিশীলতার ওপর। যদি দ্রুত সংস্কার, কঠোর তদারকি এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ব্যাংক খাতের এই অস্থিরতা আরও তীব্র আকার ধারণ করে পুরো অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে গভীর তারল্য সংকটের মুখোমুখি। অনেক সাধারণ গ্রাহক তাদের জমা রাখা অর্থ সময়মতো তুলতে পারছেন না, যা ব্যাংকগুলোর কার্যক্ষমতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে দীর্ঘস্থায়ী সংকট এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ যদি উদ্ধারযোগ্য না হয়, তবে এই তারল্য সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোর টেকসইতা বিপন্ন করবে।
ব্যাংকিং খাত নিয়ে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা উল্লেখ করেছেন, গত কয়েক বছরে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। বিশেষ করে এস. আলম গ্রুপকে সমগ্র ব্যাংকিং খাতের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানও এই ক্ষতিসাধনে অবদান রেখেছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এস. আলম গ্রুপ এবং এর মালিক সাইফুর আলম ব্যাংকিং খাত থেকে ২ লক্ষ কোটি টাকার বেশি (প্রায় ২ ট্রিলিয়ন টাকা) লুটপাট করেছেন, যার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অর্থ পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই কম।
সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জার্মানির ওটিএইচ অ্যামবার্গ-ওয়েইডেনের উদ্যোগে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুর, যিনি সাম্প্রতিক (২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর) ব্যাংক খাতের সমস্যা ও সমাধানের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও উল্লেখ করেছেন যে, দেউলিয়াত্বের মুখোমুখি থাকা ব্যাংকগুলোর নাম জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয়নি, তবে খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা ও অর্থনীতির ক্ষতি কমানোর জন্য তা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি দ্রুত কাঠামোগত সংস্কার, তদারকি ও দায়বদ্ধ ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে ব্যাংক খাতের এই অস্থিরতা শুধুমাত্র গ্রাহক ও ব্যাংকগুলোর জন্য নয়, পুরো দেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কমাতে আমাদের করণীয়: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা পুনঃস্থাপন করতে হলে শক্তিশালী কর্পোরেট সুশাসন, কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং স্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদন অপরিহার্য। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে এবং অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার বাড়িয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
নীতিনির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর করণীয় হিসেবে প্রথমে প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দক্ষ পেশাদারদের নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ গঠন এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করা। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করা এবং ব্যাংকের প্রতিবেদন ও কার্যক্রমকে খোলামেলা প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল রূপান্তর ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক। ফিনটেক ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে নতুন আর্থিক পণ্য তৈরি করা এবং ঝুঁকি ও ত্রুটির তৎপরতা কমানো সম্ভব।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ করণীয় হিসেবে কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক প্রণোদনা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। কর্মকর্তাদের বেতন ও বোনাস তাদের কর্মক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত করা হলে ভালো পারফরম্যান্সকে পুরস্কৃত এবং খারাপ পারফরম্যান্সকে হ্রাস দেওয়া সম্ভব। ঋণ ঝুঁকি ও তারল্য সংকট মোকাবেলায় উন্নত ক্রেডিট ও মার্কেট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করা আবশ্যক। এছাড়াও প্রযুক্তি, ঝুঁকি ও সম্মতি বিষয়ে দক্ষ জনবল নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও মানসম্মত বেতন প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকের প্রতিভা ধরে রাখা যেতে পারে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা জরুরি। ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করে গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংক ব্যর্থতার ক্ষেত্রে পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে শুধু ব্যাংক খাতই নয়, পুরো অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে গভীর অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। ১২টি ব্যাংক দেউলিয়ার মুখে, ১৫টি ব্যাংক টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে, এই চিত্র শুধু খাতের নয়, পুরো অর্থনীতির জন্যও শঙ্কাজনক। খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, তারল্য সংকট, দুর্নীতি এবং শিথিল তদারকির কারণে সাধারণ আমানতকারীর আস্থা ও বিনিয়োগের পরিবেশ বিপন্ন।
তবে সময়মতো নীতি-সংস্কার, শক্তিশালী কর্পোরেট সুশাসন, কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দৃঢ় পদক্ষেপ, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা এবং সাধারণ গ্রাহকের আস্থার পুনঃস্থাপন, এই তিনটি উপাদানই খাতকে স্থিতিশীল ও টেকসই করতে পারে। ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার বাইরে নিয়ে আসতে সুশাসন, প্রযুক্তি ও জবাবদিহিতার সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিলে শুধু ব্যাংকগুলোই টিকে থাকবে না, বরং দেশের অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হবে।

