বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রকাশ, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্পোরেট আমানতকে এজেন্ট সংগ্রহ হিসেবে দেখিয়ে ১০৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তারা এজেন্ট কমিশনের নামে অর্থ আত্মনিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পরিচালিত তদন্তে এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগ, ট্রেজারি, আর্থিক প্রশাসন বিভাগ ও ঊর্ধ্বতন নির্বাহীর জড়িত জালিয়াতির চিত্র ফুটে ওঠে। পরিদর্শকরা উল্লেখ করেছেন, সুসংহত সিন্ডিকেট ও জটিল ব্যবস্থাপনার কারণে এই অনিয়ম প্রায় এক দশক ধরে চালু ছিল। এর ফলে তহবিল অপব্যবহার, আর্থিক ক্ষতি ও কর ফাঁকি হয়েছে। গত এপ্রিলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ফরমান চৌধুরী, নাদিম ও ট্রেজারি প্রধান আবদুল মোবিনসহ আট কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়।
আল-আরাফাহ ২০১৫ সালে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কম খরচে আর্থিক পরিষেবা ও ছোটো আমানত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করে। ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটি এজেন্টদের ১.৫–৩ শতাংশ হারে ৩৬১.১১ কোটি টাকা কমিশন প্রদান করেছে। পরিদর্শকরা দেখেন, কমিশনের বেশিরভাগ প্রকৃত তৃণমূল আমানতের ভিত্তিতে দেয়া হয়নি। বরং, বড় কর্পোরেট আমানতকে এজেন্ট আমানত হিসেবে দেখানো হয়েছিলো। এতে ১০৯.২১ কোটি টাকা ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বা যুক্ত আউটলেটে চলে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করেছে, এজেন্ট ব্যাংকিং মূলত নিম্ন আয়ের গ্রাহকের জন্য, যেখানে লেনদেন ১০–১৫ লাখ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। কিন্তু আল-আরাফাহ এজেন্টদের মাধ্যমে কর্পোরেট আমানত রুট করে ১২–১৩ শতাংশ সুদ ও অতিরিক্ত কমিশন অফার করেছিল। এছাড়া ব্যাংক ২০১৫–২০২৪ সালে ৩৬.১১ কোটি টাকা করও রেমিট করতে ব্যর্থ হয়।
উদাহরণস্বরূপ, তৎকালীন রিলেশনশিপ ম্যানেজার ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট আসাদুর রহমান সিভিল এভিয়েশন ওয়েলফেয়ার ফান্ড থেকে ২৩ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেন। কিন্তু এটি আটিপাড়া এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে সংগৃহীত দেখানো হয়। ফান্ডের অ্যাকাউন্টে তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ব্যবহৃত হয়। পরে এটি মুছে ফেলা হয়। ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও বরিশাল জুড়ে বিতরণকৃত অনেক আমানত ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আসাদুর রহমান ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছেন, তবে তদন্ত চলার কারণে তা গৃহীত হয়নি।
এজেন্ট ব্যাংকিং বিভাগের অন্য কর্মকর্তা সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার শহিদুল হোসেন মোল্লা এন্টারপ্রাইজের মালিক ছিলেন। এই আউটলেটের মাধ্যমে কর্পোরেট আমানত রুট হয়। ২০২৩ সালের জুনে ২১ লাখ টাকা তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়। তদন্তে তার স্ত্রী ও বোনের সন্দেহজনক লেনদেনও চিহ্নিত হয়। আসাদুর রহমানের সংগৃহীত আমানত মোল্লা এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে তার পরিবারের সম্পর্কিত কয়েকটি এন্টারপ্রাইজে পাঠানো হয়। সাবেক সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট শাখাওয়াত হোসেনও ২০২২–২০২৪ সালের মধ্যে একই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন। ২০২৪ সালের মে মাসে আজহার ট্রেডার্স থেকে ৫০ লাখ টাকা মুনতাহা এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয় এবং সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবেদ আহমেদ খানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের নামে জমা করা হয়। পরিদর্শকরা আবেদ আহমেদকে সুবিধাভোগী মালিক হিসেবে চিহ্নিত করেন।
একা ২০২৪ অর্থবছরে এই অ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আর্থিক প্রশাসনের পর্যায়ে সিএফও নাদিম অতিরিক্ত আমানতের হার অনুমোদনের জন্য নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ১১.২৫–১২.৭৫ শতাংশ অনুমোদন দিলেও নাদিম ১৩ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদন দিয়েছেন। তিনি নির্দিষ্ট শাখায় ১.২৫ শতাংশ ‘কমিশন ভাগাভাগি’ ব্যবস্থা করেছিলেন।
এই স্কিমের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ২৮৫.২৫ কোটি টাকা অপব্যবহার হয়েছে। এর মধ্যে ১৮৬.৭৫ কোটি টাকা অতিরিক্ত সুদ ও ১০৯.২১ কোটি টাকা অতিরিক্ত কমিশন হিসেবে গেছে। পরিদর্শকরা উল্লেখ করেছেন, এফএডি, ট্রেজারি ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা জ্ঞাত ছিল। তারা আরও দেখেছেন, কর্মকর্তারা কীভাবে জেনারেল লেজার ব্যবহার করে আয় গোপন ও কর ফাঁকি দিয়েছেন। ফরমান চৌধুরী এবং নাদিম এফডিআর রুট করে এবং পরে ক্যাশ আকারে উত্তোলন করেছেন। এফএডি কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেনও এতে জড়িত ছিলেন।
ফরমান চৌধুরী ও নাদিম অতিরিক্ত প্রণোদনা বোনাস হিসেবে যথাক্রমে ৫১.৯ লাখ ও ১.৯ লাখ টাকা পেয়েছেন। পরিদর্শকরা বলেন, মূল বিভাগের কর্মকর্তারা ৫–২০ বছর একই স্থানে থাকায় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল।