বিশ্বজুড়ে দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজার। পুঁজিবাজারের মতোই চলে এই ভার্চুয়াল মুদ্রার লেনদেন। বৈধতা না থাকলেও বাংলাদেশেও এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে।
দেশে ক্রিপ্টো লেনদেনের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম বাইনান্স। অনেক ফ্রিল্যান্সার তাদের পারিশ্রমিক ক্রিপ্টোতে নিচ্ছেন এবং বাইনান্সের মাধ্যমে তা স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালে বিটকয়েনসহ সব ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রা লেনদেন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এই ধরনের লেনদেন অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের ঝুঁকি বাড়ায়। ২০১৭ ও ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবারও সতর্কবার্তা দেয়—ক্রিপ্টো লেনদেনে আর্থিক ক্ষতি ও আইনি ঝুঁকি উভয়ই রয়েছে। তবু বাস্তবে নিষেধাজ্ঞার তেমন প্রভাব নেই। ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ থাকায় মানুষ গোপনে ক্রিপ্টো ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা চালুর উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ২০২২–২৩ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ডিজিটাল মুদ্রা চালুর সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। এরপর আরও তিনটি বাজেট এসেছে, কিন্তু বিষয়টি এখনো কাগজেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের মুখপাত্র মো. আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ডিজিটাল মুদ্রা চালুর আলোচনা হয়নি। বিষয়টি বড় ও সময়সাপেক্ষ।’ প্রতিবেশী ভারত ২০২২ সালের ডিসেম্বরে নিজেদের ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে।
বিশ্বে প্রথম ক্রিপ্টোকারেন্সি চালু হয় ২০০৯ সালে। ১৬ বছরে এর বাজার কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিপ্টো বিটকয়েন, যার বাজারমূল্য ৯১৬.১৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর ইথেরিয়াম (৪৮৩.৮ বিলিয়ন), বাইনান্স কয়েন (১৬৮.১৪ বিলিয়ন), টিথার (৭৭.৯৯ বিলিয়ন), এক্সআরপি (৪৭.৫৪ বিলিয়ন) ও ইউএসডি কয়েন (৪২.১৬ বিলিয়ন) রয়েছে। কয়েনজেকোর তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৮ হাজারের বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্র্যাক করা হচ্ছে। ট্যানজেমের হিসাবে ২০২২ সালের শেষে টোকেনের সংখ্যা ৩৭ মিলিয়নেরও বেশি ছিল, যদিও অনেকগুলো এখন নিষ্ক্রিয়।
বাইনান্স বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্ম। ২০১৭ সালে চীনের চাংপেং ঝাও এটি প্রতিষ্ঠা করেন। চীনের কঠোর অবস্থানের পর এটি জাপান, পরে মাল্টায় স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এটি বিকেন্দ্রীভূতভাবে পরিচালিত হয় এবং ১৯০টিরও বেশি দেশে সেবা দিচ্ছে। বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সারদের পাশাপাশি অনলাইন বেটিংসহ অবৈধ লেনদেনেও বাইনান্স ব্যবহৃত হচ্ছে। যেহেতু এসব কার্যক্রমে ব্যাংকিং চ্যানেল নিষিদ্ধ, তাই ক্রিপ্টো প্ল্যাটফর্মগুলো বিকল্প পথ হয়ে উঠছে। এতে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকিও বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেস থেকে আয় করা অনেক ফ্রিল্যান্সার বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের জটিলতা এড়াতে ক্রিপ্টোর ওপর নির্ভর করছেন। ঢাকার মিরপুরের ফ্রিল্যান্সার কায়েস মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘বাইনান্সে পেমেন্ট নেওয়া সহজ। ডলারের দর বাড়লে বিক্রিতে বাড়তি লাভও হয়।’ ফ্রিল্যান্সাররা বাইনান্সে পাওয়া ক্রিপ্টো বাংলাদেশে থাকা এজেন্টদের কাছে বিক্রি করে বিকাশ, নগদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সহজেই টাকা তুলছেন। এতে সময় ও খরচ দুটোই কম।
বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্ক করেছে—ক্রিপ্টো অনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় প্রতারণা, লোকসান ও অবৈধ অর্থায়নের ঝুঁকি অনেক। তবুও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের বিকাশে গোপনে এর ব্যবহার বাড়ছে। ব্লকচেইন বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান চেনালাইসিসের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫১টি দেশের ক্রিপ্টো ব্যবহার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৫। শীর্ষে আছে ভারত, নাইজেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। বাংলাদেশের পেছনে আছে মিয়ানমার (৭৮), শ্রীলঙ্কা (৭২) ও নেপাল (৭১)। পাকিস্তানের অবস্থান ৯, যুক্তরাষ্ট্র ৪ এবং অস্ট্রেলিয়া ৩৯ নম্বরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর নজরদারির মধ্যেও ডিজিটাল অর্থনীতির সম্প্রসারণ ক্রিপ্টোর ব্যবহার ঠেকাতে পারছে না। এই বাস্তবতায় ব্যবহারকারীদের জন্য সুযোগ যেমন আছে, ঝুঁকিও তেমনি বিশাল।