বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে অর্থনীতির সবচেয়ে নাজুক ও সংবেদনশীল স্থানে অবস্থান করছে। এক সময় এই খাত ছিল উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও শিল্প প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা পরিণত হয়েছে অদক্ষ পরিচালনা, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়মের জটিল ঘূর্ণাবর্তে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডিফল্ট ঋণ লাগাতার বাড়ছে, নন-পারফর্মিং লোনের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, আর অনেক ব্যাংকেই তারল্য সংকট স্থায়ী রূপ নিয়েছে।
এই সংকটের পেছনে কেবল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপ নয়, মূলতঃ রয়েছে দুর্বল কর্পোরেট গভর্ন্যান্স, রাজনৈতিক প্রভাব, আর পরিচালন পর্যায়ে অভিজ্ঞতা ও জবাবদিহির ঘাটতি। অদক্ষ পরিচালনার এই দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব শুধু ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট করছে না, বরং সমগ্র অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাচ্ছে, আমানতকারীরা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন, আর সাধারণ মানুষ হারাচ্ছেন ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস।
ফলস্বরূপ খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, তারল্য সংকট ও আস্থাহীনতা এখন খাতটির প্রধান চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। অনেক ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতি ও প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। তাই ব্যাংক খাতে অদক্ষ পরিচালনা ও অনিয়মের এই ধারাবাহিকতা রোধে জরুরি সংস্কার, কঠোর তদারকি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা আজ সময়ের অনিবার্য দাবি।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে ক্রমবর্ধমান ঋণখেলাপি ও অনাদায়ী ঋণের সংকটে জর্জরিত। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট অনাদায়ী ঋণের অনুপাত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে, যা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক রেকর্ড মাত্রা। এই সময়ে ব্যাংক খাতে মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা খেলাপি হিসেবে শ্রেণিভুক্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগস্ট-২০২৫ শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের মোট স্থিতি ১৭ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের তুলনায় ৩৫ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা বেশি। তবে প্রবৃদ্ধির হার নামমাত্র পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ঘাটতির কারণে শিল্প খাতের সম্প্রসারণও ব্যাহত হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি বর্তমানে এক ভজঘট পরিস্থিতির মুখোমুখি। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে অনেক প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা তাদের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় খেলাপি ঋণ হঠাৎ বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আশঙ্কা, বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যেই ব্যাংক খাতে অনাদায়ী ঋণের হার ৩০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি তৈরি করবে। এই বিপজ্জনক ঊর্ধ্বগতির পেছনে মূলতঃ তিনটি কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে: দুর্বল কর্পোরেট গভর্ন্যান্স, রাজনৈতিক প্রভাব এবং পরিচালনা পর্যায়ের অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব। এর ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন সুরক্ষা দুর্বল হচ্ছে এবং তারল্য সংকট ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করছে।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ডিফল্ট ঋণের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২ দশমিক ৩৮ ট্রিলিয়ন টাকা বেড়েছে। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞগণের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এই বৃদ্ধি মূলতঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ও কঠোর ঋণ শ্রেণিকরণ নীতিমালা কার্যকর হওয়ার পর দেখা দেয়। পাশাপাশি কিছু বড় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল আর্থিক অবস্থাও এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
খেলাপি ঋণের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধি শুধু ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং সার্বিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য না থাকায় নতুন বিনিয়োগে ঋণ বিতরণ কমে যাচ্ছে, যার ফলে শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এভাবে ঋণখেলাপি ও পরিচালনাগত অদক্ষতা যদি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে দেশের সামগ্রিক আর্থিক কাঠামো ঝুঁকির মুখে পড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে যাবে।
বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ২২ বছরে সর্বনিম্নে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উচ্চ সুদের কারণে দেশের বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবির। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি জুন থেকে আগস্টের মধ্যে ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আগস্টে এটি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন নতুন বিনিয়োগ স্থগিত হয়েছে, পাশাপাশি চালু থাকা কারখানার কিছু অংশও বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বৃদ্ধি করায় ঋণ ব্যয় বেড়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ সালের পর এটাই সর্বনিম্ন ঋণ প্রবৃদ্ধি। গত বছরের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং সরকারের পরিবর্তনের পর থেকে বিনিয়োগ স্থবির। সরকারি ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত বা স্থগিত হওয়ায় ব্যাংকগুলো প্রধানত সরকারি বন্ড ও বিলেই বিনিয়োগ করছে। ফলে এখন সময় এসেছে ব্যাংক পরিচালনায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর তদারকি ছাড়া এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের অন্য কোনো পথ নেই।
অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রাসঙ্গিক চিত্র: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষ পরিচালনা এখন আর বিচ্ছিন্ন সমস্যা নয়, এটি পরিণত হয়েছে একটি কাঠামোগত ব্যর্থতায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের উদ্যোগে একাধিক তদন্তে উঠে এসেছে ব্যাংক পরিচালনা পর্যায়ে প্রশাসনিক দুর্বলতা, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়মের গভীর শেকড়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ বিতরণ, সম্পদ স্থানান্তর এবং প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনা কেবল নীতিনৈতিকতার লঙ্ঘন নয়, বরং ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ও স্থিতিশীলতাকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে, যেখানে বোর্ড-পর্যায়ে অনিয়ম, অভ্যন্তরীণ তথ্য ফাঁস ও ঋণ অনুমোদনে জালিয়াতির মতো অভিযোগ উঠে এসেছে। এর মধ্যে সাউথ ইস্ট ব্যাঙ্ক এর ঘটনাটি বিশেষভাবে আলোচিত, যেখানে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে insider trading, আর্থিক অনিয়ম ও বোর্ড পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বজনপ্রীতির অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা প্রমাণ করে, ব্যাংক পরিচালনায় গভর্ন্যান্সের দুর্বলতা কতটা গভীর এবং কিভাবে তা পুরো আর্থিক খাতকে প্রভাবিত করছে।
অদক্ষ পরিচালনা, দুর্নীতি এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাবে বর্তমানে ব্যাংক খাত এক জটিল ‘ঝুঁকি-চক্রে’ আটকে পড়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ার ফলে ব্যাংকগুলোর রাজস্ব ও তারল্য কমে যাচ্ছে, ফলে নতুন বিনিয়োগে ঋণ বিতরণ ব্যাহত হচ্ছে। বাজারে তরল সম্পদের ঘাটতি তৈরি হওয়ায় শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। একই সঙ্গে গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস পাওয়ায় আমানত প্রত্যাহারের প্রবণতা বাড়ছে, যা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন ২০২৩–এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ব্যাংক খাতে ঋণঝুঁকি ও পরিচালনাগত ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে Risk-Based Supervision (RBS) পদ্ধতি চালু করেছে, যাতে প্রতিটি ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিবিড়ভাবে তদারকি করা যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতিগত উদ্যোগ যথেষ্ট হলেও বাস্তবায়নে এখনো ঘাটতি রয়ে গেছে।
দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়া ঋণ বিতরণের ফলে খেলাপি ঋণ ক্রমেই বাড়ছে। এর পাশাপাশি আর্থিক অনিশ্চয়তা ও বাজারে আতঙ্কের পরিবেশ ব্যবসায়িক আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। অনেক ব্যাংক পর্যাপ্ত মূলধন থাকলেও কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাবে তারা তারল্য সংকটে পড়ছে। যা ঋণ, বাজার ও পরিচালনাগত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাঁধা সৃষ্টি করছে।
এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও জলবায়ু ঝুঁকিও এখন ব্যাংকিং খাতে পরোক্ষ প্রভাব ফেলছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের অর্থনৈতিক অভিঘাত ব্যাংকের সম্পদ ও বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। একই সঙ্গে মালিকানাধীন পুঁজির ঘাটতি ও মূলধনের দুর্বলতা ব্যাংকগুলোকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছে।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, ব্যাংক খাতের বর্তমান অনিয়ম ও দুর্বলতার মূল কারণ হলো অদক্ষ নেতৃত্ব, স্বচ্ছতার অভাব এবং জবাবদিহিহীন পরিচালন ব্যবস্থা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ, ঋণ মূল্যায়নে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও স্বাধীন তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করলে এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না। এখনই যদি কাঠামোগত সংস্কার শুরু না হয়, তবে এই সংকট গোটা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকেই স্থবির করে দিতে পারে।
কেন ঘাটতি হচ্ছিল এর মূল কারণগুলো হলো: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান সংকটের মূল শিকড় লুকিয়ে আছে এর পরিচালন কাঠামো ও তদারকি ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের দুর্বলতায়। এই ঘাটতিগুলো কোনো একদিনে তৈরি হয়নি; বরং বছরের পর বছর অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব ও স্বজনপ্রীতির কারণে একটি জটিল সংকট কাঠামো গড়ে উঠেছে, যা আজ ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তুলেছে।
প্রথমত: কর্পোরেট গভর্ন্যান্স বা প্রশাসনিক শাসনের দুর্বলতা এই সংকটের প্রধান কারণ। অনেক ব্যাংকের বোর্ডে দক্ষ পেশাদারদের বদলে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পদ পেয়েছেন, যাদের অনেকেরই ব্যাংক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা নেই। ফলে ঋণ বিতরণ, বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ও ঝুঁকি মূল্যায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে পেশাদার নীতি অনুসরণের পরিবর্তে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে নীতি ও বাস্তবতার মধ্যে একটি বিপজ্জনক ফাঁক তৈরি হয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থাকে ক্রমেই দুর্বল করে তুলেছে।
দ্বিতীয়ত: সংস্থাগত দুর্বলতা ও নিয়ন্ত্রকের সীমিত সক্ষমতা সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট তদারকি সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, অনেক সময় সময়মতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক বা ঋণ অনিয়ম শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। নিয়মিত অডিট ও পরিদর্শন প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রে কাগুজে রয়ে গেছে, আর আর্থিক প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কার্যকর তদারকির অভাব দেখা দিয়েছে। তথ্য-অপ্রতুলতা, স্বচ্ছতার ঘাটতি এবং তদারকিতে ধীরগতি ব্যাংক খাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে, যা পরবর্তীতে ডিফল্ট ঋণ ও তারল্য সংকটের রূপ নিয়েছে।
তৃতীয়ত: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহার ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি জনআস্থা নষ্ট করেছে। ক্ষমতার প্রভাবে ঋণ অনুমোদন, জামানত ছাড়াই বড় অঙ্কের অর্থ বিতরণ এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপের ঘটনা এই খাতে দুর্নীতির সংস্কৃতি প্রোথিত করেছে। দেশের বেশ কয়েকটি বড় ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা শুধু ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভারসাম্য নষ্ট করেনি, বরং একটি অস্বাস্থ্যকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিভিন্ন অনুসন্ধান ও অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের এই কাঠামোগত ত্রুটি ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
সবশেষে এই ঘাটতিগুলো একসঙ্গে মিলে ব্যাংক খাতের অভ্যন্তরে একটি অদক্ষ ও অনির্ভরযোগ্য পরিচালন সংস্কৃতি তৈরি করেছে। যেখানে দক্ষতা, জবাবদিহি ও নৈতিকতা প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সুযোগসন্ধানী সিদ্ধান্ত ও প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এই কাঠামোগত ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হলে শুধুমাত্র নীতিমালা সংশোধন নয়; বরং দরকার নৈতিক নেতৃত্ব, স্বচ্ছ বোর্ড পরিচালনা এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক ক্ষমতার বাস্তবায়ন। ব্যাংক খাতে প্রকৃত সংস্কার শুরু হতে হবে এখান থেকেই।
ঝুঁকি নিরসনের উপায়: বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে যে অদক্ষ পরিচালনা, অনিয়ম ও আর্থিক ঝুঁকির মুখোমুখি, তা কাটিয়ে উঠতে প্রয়োজন একটি শক্তিশালী ও টেকসই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গঠন। শুধুমাত্র নিয়ম-নীতির সংস্কার নয়, বরং ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে এই খাতকে পুনর্গঠিত করতে হবে।
প্রথমত: প্রতিটি ব্যাংকে একটি সমন্বিত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ঝুঁকি সনাক্তকরণ, মূল্যায়ন, পরিমাপ, পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরির কার্যক্রম নিয়মিতভাবে পরিচালিত হবে। এই কাঠামোর মাধ্যমে ঋণ, বাজার, পরিচালনাগত ও তারল্য ঝুঁকি পূর্বাভাসের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি ঝুঁকির সীমা নির্ধারণ ও তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে প্রতিটি ব্যাংককে জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়ায় আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত: প্রযুক্তি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এখন সময়ের দাবি। দেশের অনেক ব্যাংক এখনো পুরনো সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর অবকাঠামোর উপর নির্ভর করছে, যা সাইবার ঝুঁকি ও তথ্য ফাঁসের সম্ভাবনা বাড়ায়। সুতরাং ব্যাংকগুলোর উচিত ডিজিটাল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করা, উন্নত অ্যানালিটিকস ও তথ্য বিশ্লেষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, যাতে প্রতারণা ও আর্থিক অনিয়ম দ্রুত শনাক্ত করা যায়।
তৃতীয়ত: মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ, নৈতিকতা ও ঝুঁকি সচেতনতা বিষয়ক কর্মশালা আয়োজন করা প্রয়োজন। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি পাবে এবং অদক্ষ পরিচালনার প্রবণতা কমবে। একই সঙ্গে ব্যাংকের তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগকে শক্তিশালী করা জরুরি, যাতে ডেটা এন্ট্রির ভুল বা তথ্য বিকৃতির মতো সমস্যা রোধ করা যায়।
এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থা আরও কার্যকর ও কঠোর হওয়া দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের Risk-Based Supervision (RBS) পদ্ধতি ইতোমধ্যে চালু হলেও, এর বাস্তব প্রয়োগ এখনো সীমিত। প্রতিটি ব্যাংকের জন্য আলাদা তদারকি দল গঠন করে তাদের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। অর্থপাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে (AML-CFT) বিশেষায়িত বিভাগ গঠন করাও জরুরি, যাতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে ঝুঁকি নিরূপণ ও প্রতিরোধ সম্ভব হয়।
ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলোকেও পুনর্গঠন করতে হবে। অদক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো ও জটিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অনেক সময় ঋণ বিতরণ বা ঝুঁকি মূল্যায়নে বিলম্ব ঘটায়। তাই কাজের প্রবাহে গতিশীলতা আনতে প্রক্রিয়া পুনঃনকশা প্রয়োজন, যাতে দক্ষতা বাড়ে এবং ভুল সিদ্ধান্তের ঝুঁকি কমে।
পরিশেষে ব্যাংক পরিচালনায় নৈতিকতা ও সুশাসনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত যেন আর্থিক বাস্তবতা ও নীতিগত সততার ভিত্তিতে গৃহীত হয়, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। ব্যাংকিং খাত কেবল মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র নয়; এটি জনগণের সঞ্চয় ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতিফলন। তাই এই খাতে স্বচ্ছতা, পেশাদারিত্ব এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ঝুঁকি ও অনিয়ম অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত আজ শুধু অর্থনীতির মূল স্তম্ভই নয়, দেশের অর্থনৈতিক আস্থা ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রতীক। কিন্তু দীর্ঘদিনের অদক্ষ পরিচালনা, প্রশাসনিক দুর্বলতা, স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক অনিয়ম এই খাতকে এক জটিল ঝুঁকি চক্রে আবদ্ধ করেছে। খেলাপি ঋণ, তারল্য সংকট ও বিনিয়োগে বাঁধা এই সংকটের সরাসরি ফল। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মালিকানাধীন মূলধনের ঘাটতি এবং আধুনিক প্রযুক্তি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অভাব আরও তীব্রতা যোগ করেছে।
এই অবস্থার মোকাবিলায় ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার পুনর্গঠন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, নিয়মিত তদারকি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করা ছাড়া এই খাতের স্থিতিশীলতা পুনঃস্থাপন সম্ভব নয়। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর তদারকি এবং ব্যাংকের নীতি ও নৈতিক মানদণ্ডের প্রতি কঠোর আনুগত্য নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংক খাতের সংস্কার কেবল অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন এবং দেশের অর্থনীতিকে টেকসই প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্যও জরুরি। যদি এখনই কাঠামোগত সংস্কার ও নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হয়, তবে বাংলাদেশে একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও স্বচ্ছ ব্যাংকিং পরিবেশ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যা দেশের সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চিত ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।