একসময় ব্যাংক বলতে বোঝাতো দীর্ঘ লাইন, ফর্ম পূরণ আর সীমিত সময়ের ভেতর লেনদেনের ঝক্কি। কিন্তু সেই চিত্র এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। শহর কিংবা গ্রাম—সব জায়গায় ব্যাংকিং চলে এসেছে মানুষের হাতের মুঠোয়। স্মার্টফোনে কয়েকটি ট্যাপেই এখন বিল পরিশোধ, ভাড়া দেওয়া, টাকা পাঠানো, একাউন্ট খোলা বা ট্যাক্স সার্টিফিকেট ডাউনলোড—সবই সম্ভব।
এই পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছে সিটি ব্যাংকের ‘সিটিটাচ’, ব্র্যাক ব্যাংকের ‘আস্থা’, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ‘নেক্সাসপে’, ইস্টার্ন ব্যাংকের ‘স্কাই ব্যাংকিং’সহ নানা ব্যাংকিং অ্যাপ।
ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের উত্থান
বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের যাত্রা শুরু হয় ২০১৩ সালে সিটি ব্যাংকের ‘সিটিটাচ’ অ্যাপ চালুর মাধ্যমে। প্রথম সাত বছরে ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৭২ হাজার। কিন্তু পরের সাড়ে চার বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮ লাখ ৮২ হাজারে, যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৬৫ শতাংশের বেশি।
কোভিড-১৯ মহামারি এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে। মানুষ যখন ঘরে বন্দি, তখন দৈনন্দিন ব্যাংকিং সেবার জন্য নির্ভর করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ওপর।
ফলাফল চমকপ্রদ—২০২০ সালে ‘সিটিটাচ’-এর দৈনিক লেনদেন ছিল ২৭ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪০০ কোটি টাকায়।
এই প্রবৃদ্ধি শুধু প্রযুক্তির নয়, বরং মানুষের অভ্যাস বদলের এক গল্প। এখন প্রতি মাসে কেবল মানবসম্পদ খরচেই ব্যাংকটি সাশ্রয় করছে প্রায় ২০ কোটি টাকা।
ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা: নতুন মাইলফলক
ব্র্যাক ব্যাংকের ‘আস্থা’ অ্যাপ ইতিমধ্যেই ১১ লাখ ব্যবহারকারী অতিক্রম করেছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন, “আস্থার মাধ্যমে আমরা ব্যাংকিং সেবাকে এক কাপ চা খাওয়ার সময়ের মধ্যেই পৌঁছে দিতে পেরেছি।”
প্রতিদিন এই অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন হয় প্রায় ৭০০ কোটি টাকা, আর মাসিক লেনদেন দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
ব্যাংকের প্রধান ডিজিটাল কর্মকর্তা মোকাররবিন মান্নান বলেন, “এটি এখন শুধু সুবিধা নয়, বরং জীবনধারার অংশ। মানুষ তাদের আর্থিক পরিকল্পনাও করছে এই অ্যাপের মাধ্যমে।”
। প্রতি মাসে লেনদেনের পরিমাণ ছাড়িয়ে গেছে ২১ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ইস্টার্ন ব্যাংকের ‘স্কাই ব্যাংকিং’ অ্যাপের ব্যবহারকারী ৪.৫ লাখ হলেও গত পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৩৭ শতাংশ। লেনদেন বেড়েছে ৭৭৫ শতাংশ, আর মোট লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে ২,৬৯৫ শতাংশ—যা ব্যাংকটির দ্রুত অগ্রগতির প্রমাণ।
কীভাবে ব্যাংকগুলো সাশ্রয় করছে কোটি কোটি টাকা
প্রতিদিন গড়ে সিটি ব্যাংকের ১ লাখ ১০ হাজার ব্যবহারকারী ‘সিটিটাচ’ অ্যাপে লেনদেন করে। এই সেবা যদি শাখায় দিতে হতো, তবে প্রয়োজন হতো প্রায় ২৫ হাজার মানুষঘণ্টা, অর্থাৎ ৩ হাজার কর্মচারীর কাজের সমান। গড় মাসিক বেতন হিসেবে ধরা হলে, ব্যাংকটি বছরে প্রায় ২৪০ কোটি টাকা সাশ্রয় করছে।
ব্র্যাক ব্যাংকেও প্রতিদিন ১.৫ থেকে ২ লাখ গ্রাহক অ্যাপ ব্যবহার করেন, যার ফলে সাশ্রয় হচ্ছে লাখ লাখ মানুষঘণ্টা। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, এখানেও সাশ্রয়ের অঙ্ক কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
ব্যাংকিং অ্যাপে এখন কী কী করা যায়
আগে যেখানে অ্যাপ মানে ছিল শুধু ব্যালান্স দেখা, এখন সেখানে পাওয়া যায় প্রায় সব ব্যাংকিং সেবা।
গ্রাহকরা এখন সহজেই অর্থ স্থানান্তর করতে পারেন একই ব্যাংকের মধ্যে বা অন্য ব্যাংকে BEFTN, RTGS, NPSB নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। বিকাশ, নগদ, রকেট-এও টাকা পাঠানো যায় সরাসরি।
এছাড়া মোবাইল রিচার্জ, ইউটিলিটি বিল, ক্রেডিট কার্ড বিল, শিক্ষা ফি বা ই-কমার্স পেমেন্ট—সবই এখন অ্যাপের মাধ্যমে করা সম্ভব।
অনেকে অ্যাপ থেকে সরাসরি নতুন একাউন্ট, ডিপিএস, এফডিআর খুলছেন, ঋণ আবেদন করছেন এবং ট্যাক্স সার্টিফিকেট বা ব্যাংক স্টেটমেন্ট ডাউনলোড করছেন।
অ্যাপগুলোতে এখন রয়েছে বায়োমেট্রিক লগইন, রিয়েল-টাইম নোটিফিকেশন এবং এআই চ্যাট সাপোর্ট, যা ব্যাংকিংকে করে তুলেছে ২৪ ঘণ্টার সেবা।
কারা ব্যবহার করছেন এসব অ্যাপ
গবেষণা বলছে, অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী তরুণ প্রজন্ম—বিশেষ করে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা।
ব্র্যাক ব্যাংকের ‘আস্থা’ অ্যাপের ৫৩ শতাংশ ব্যবহারকারী ২১-৩৫ বছর বয়সী, আর সিটি ব্যাংকের ‘সিটিটাচ’-এর অর্ধেকের বেশি ব্যবহারকারী ২৫-৪০ বছরের মধ্যে।
তরুণ প্রজন্মের কাছে অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং এখন শুধু একটি আর্থিক সেবা নয়, বরং দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।
সীমাবদ্ধতাও আছে
তবে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
যেমন, ফ্রিল্যান্সার মোহাম্মদ কায়েস জানান—বিদেশ থেকে ব্যাংক-টু-ব্যাংক অর্থ পাঠালে তাকে চুক্তিপত্র ও ইনভয়েস জমা দিতে হয়, যা মানি ট্রান্সফার কোম্পানি থেকে আসলে লাগে না।
সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা সাঈদ ইব্রাহিম সাআজিদ বলেন, এখনো অনেক ক্ষেত্রে কাগজে স্বাক্ষর (‘wet signature’) প্রয়োজন হয়, এমনকি ৫০ হাজার টাকার ঋণের জন্যও। এছাড়া ডিজিটালি খোলা একাউন্টে মাসিক লেনদেনের সীমা মাত্র ১ লাখ টাকা, যেখানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে সীমা অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “যদি ব্যাংকগুলো মনে করে এসব সীমাবদ্ধতা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের অগ্রযাত্রায় বাধা, তাহলে তারা প্রস্তাব দিতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আলোচনা করতে প্রস্তুত।”বাংলাদেশে ব্যাংকিং এখন কেবল শাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তি ও গ্রাহকের চাহিদা মিলে তৈরি করছে এক নতুন বাস্তবতা—যেখানে টাকা লেনদেন, ঋণ, সঞ্চয়, এমনকি বিনিয়োগও এখন হয় আঙুলের ছোঁয়ায়।
এই পরিবর্তন শুধু ব্যাংকিংয়ের নয়, বরং বাংলাদেশের আর্থিক সংস্কৃতিরও এক মৌলিক রূপান্তর।