চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়ছে। আগস্ট মাসে প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছেছে। অর্থাৎ মানুষের হাতে ধরে রাখা টাকা আবার ব্যাংকে ফিরছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, আমানতের এই বৃদ্ধির পেছনে চারটি মূল কারণ রয়েছে। প্রথমত, গ্রাহকের আস্থা বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত। তৃতীয়ত, সুদের হার কমে যাওয়া। চতুর্থত, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার ক্রয় করছে, যা আমানত বাড়াতে সহায়তা করছে।
গত অর্থবছরে সরকার পরিবর্তন ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমানতের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৮ শতাংশে পৌঁছায়। আগস্টে তা ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট শেষে ব্যাংকে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৪ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ১৭ লাখ ৩১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা বা ১০.০২ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৪৩ শতাংশ। জুনে তা ৯.২৫ শতাংশে নেমেছিল। সরকার পরিবর্তনের পর প্রবৃদ্ধি কমতে থাকে। আগস্টে তা সর্বনিম্ন ৭.০২ শতাংশে দাঁড়ায়। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে প্রবৃদ্ধি আবার বাড়তে শুরু করে। মার্চে ৯ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়। এপ্রিলেও প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে, মে ও জুনে সামান্য কমে যায়। জুলাইয়ে তা ৮.৪২ শতাংশে পৌঁছায়। আগস্টে ১০.০২ শতাংশে পৌঁছানোর ফলে দীর্ঘ ১৭ মাস পর ব্যাংকের আমানত আবার দুই অঙ্কে পৌঁছায়।
ব্যাংকিং খাতে নানা অনিয়মে গ্রাহকের আস্থা কমে যায়। সরকার পরিবর্তন ও দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার চাপ বেড়ে যায়। ফলে মানুষের হাতে টাকা ধরে রাখা বাড়ে। তবে চলতি অর্থবছরের শুরুতে পরিস্থিতি বদলায়। ঘরের টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনটি মূল কারণে আমানত বাড়ছে। প্রথমত, ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ দৃশ্যমান হওয়ায় মানুষের আস্থা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ। তৃতীয়ত, ট্রেজারি বিল ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমে যাওয়ায় মানুষ বাধ্য হয়ে আবার ব্যাংকে টাকা রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনাও বাজারে আমানত বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সরকারের পরিবর্তনের পর অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখে। ফলে আমানত অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন উদ্যোগে আস্থা ফিরছে। অতিরিক্ত টাকা এখন আবার ব্যাংকে জমা হচ্ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহও আমানত বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে। মাত্র ১৫ দিনে এক বিলিয়নের বেশি ডলার এসেছে। সুদের হারের পরিবর্তনও আমানত বাড়াতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কেনার ফলে বাজারে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।”
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আমানত বৃদ্ধিকে সরাসরি অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য হিসেবে দেখা যাবে না। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এখনও স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। তাই বিনিয়োগ বাড়ানো এবং স্থিতিশীল বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ট্রেজারি বিলের সুদের হার এক অঙ্কে নেমেছে। সর্বশেষ নিলামে ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিনের ট্রেজারি বিলের হার যথাক্রমে ৯.৫০, ৯.৭১ ও ৯.৬০ শতাংশ। ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছরের ট্রেজারি বন্ডের হার যথাক্রমে ৯.৩৩, ৯.৮৯, ৯.৬৭ ও ৯.৭০ শতাংশে রয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সব ব্যাংকে নয়, দুর্বল ব্যাংকের আমানত কমছে। তবে শক্তিশালী ব্যাংকে আমানত বৃদ্ধি অব্যাহত। আমানত বৃদ্ধিতে এগিয়ে রয়েছে সিটি, ব্র্যাক, পূবালী, ইস্টার্ন, যমুনা, ট্রাস্ট, প্রাইম এনসিসি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, ডাচ্-বাংলা, শাহ্জালাল, উত্তরা, যমুনা ও মিডল্যান্ড ব্যাংক।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “সরকার পরিবর্তনের পর কয়েকটি ব্যাংকের প্রতি আস্থা কমে গিয়েছিল। বর্তমানে আস্থা ফিরে আসায় আমানত বাড়ছে। আশা করি এই ধারা অব্যাহত থাকবে।” বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগস্টে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৭৬ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। জুলাইয়ে এটি ছিল ২ লাখ ৮৭ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। এক মাসে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বা ৩.৭৬ শতাংশ কমেছে। বছরের তুলনায় ৫.৪৫ শতাংশ কম।