মাত্র তিন গ্রাহকের কাছেই আটকে আছে জনতা ব্যাংকের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এননটেক্স, বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপের কাছে আটকে থাকা এই বিপুল অর্থ এখন ব্যাংকটির জন্য বড় বোঝা। শুধু জনতা ব্যাংক নয়, দেশের পুরো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক খাতই এখন নাজুক অবস্থায়।
সর্বশেষ হিসাব বলছে, ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ১২০ শীর্ষ খেলাপির কাছে আটকে আছে মোট ৮৫ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের পরেই আছে অগ্রণী ব্যাংক, যার পাওনা ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের বকেয়া ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি, আর সোনালী ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।
এছাড়া বেসিক ব্যাংকের প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)-এর ৫০০ কোটি টাকা এখনও আদায় হয়নি।
দুর্বল ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের প্রস্তাব
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
তবে সবল ব্যাংকের সঙ্গে নয়— বরং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একত্রে এনে নতুন একটি ব্যাংক গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
সুপারিশে বলা হয়েছে,
“সোনালী ব্যাংকের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো। তাই চাইলে দুর্বল কোনো ব্যাংককে সোনালীর সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। এতে অতিরিক্ত ব্যয় হবে না এবং তারল্য সংকটও দেখা দেবে না।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, যদি কোনো ঋণ আদায় সম্ভব না হয়, তবে খেলাপিদের জামানত আইনের আওতায় বিক্রি করে অর্থ উদ্ধার করা যেতে পারে।
তারল্য সংকট মোকাবিলায় সোনালী ব্যাংকের ভূমিকা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এক বছরে সোনালী ব্যাংক তার নিজস্ব গ্যারান্টিতে ইসলামী ব্যাংকসহ ৬টি দুর্বল ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি কিছুটা কমেছে এবং খেলাপি ঋণও সীমিত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলে সোনালী ব্যাংকের আর্থিক সূচকগুলো ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
সোনালী ব্যাংক পিএলসির সিইও ও এমডি মো. শওকত আলী খান বলেন,
“অন্য ব্যাংকগুলো যেসব ঋণ যাচাই-বাছাই না করেই দিয়েছে, সেগুলো আদায় করা কঠিন। যদি এই ঋণগুলোর দায়িত্ব সোনালী ব্যাংকের ওপর আসে, তাহলে এটি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে এবং সম্পদের মানেও প্রভাব ফেলবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আল আমিন বলেন,
“জনতা ব্যাংক যে ঋণ দিয়েছে, তার মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই অপ্রদেয় (NPL)। কয়েকজন ব্যক্তির হাতে অযাচিতভাবে টাকা গেছে। তাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একত্রে আনলেও সেটি শুধু সাময়িক সমাধান দেবে। টেকসইভাবে শক্তিশালী করতে আলাদা নীতিমালা ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, যদি দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, তাহলে জনগণের আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
“ভালো ব্যাংকের প্রতি যে আস্থা তৈরি হয়েছে, তা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়,” বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতের টেকসই পুনরুদ্ধার শুধু অর্থ সহায়তায় সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা, সুশাসন নিশ্চিত করা, এবং ঋণ আদায়ে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেওয়াই এখন সময়ের দাবি।