দেশের ব্যাংক খাত ক্রমেই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত দুই দশকে ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন অধিকাংশ ব্যাংক তাদের নিজস্ব অ্যাপ চালু করেছে।
আজকাল লেনদেন, রেমিট্যান্স, কার্ড পেমেন্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং—সবই প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহকের সুবিধাও বেড়েছে। তবে প্রযুক্তির এই দ্রুত ব্যবহারের সঙ্গে বেড়েছে সাইবার হামলার ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো এখন শুধু গ্রাহক সেবা নয়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করাতেও জোর দিচ্ছে।
দেশের ব্যাংক খাতে প্রতিদিন গড়ে চারশর বেশি সাইবার হামলার মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এ হামলার অর্ধেকের বেশি সংঘটিত হয় চীন, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া থেকে। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ হামলা আসে চীন থেকে।
তথ্যগুলো নির্দেশ করছে, ব্যাংকে ডিজিটাল লেনদেন যত বেড়েছে, গ্রাহকের আর্থিক নিরাপত্তা ততটা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এবং পরিমিত বিনিয়োগও করা হয়নি। ২০০০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলো তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নে মোট ৫৩ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে কেবল ৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে সাইবার নিরাপত্তায়। বিনিয়োগের সিংহভাগই গেছে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও নেটওয়ার্কিংয়ে। এই বিনিয়োগ কাঠামো দেখাচ্ছে, ব্যাংকগুলো প্রযুক্তিনির্ভর সেবা সম্প্রসারণে মনোযোগ দিয়েছে, তবে প্রযুক্তিগত নিরাপত্তায় উদাসীনতা রয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা, এই উদাসীনতা দীর্ঘায়িত হলে সাইবার হামলা ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের বিকাশে বড় বাধা হয়ে উঠতে পারে।
২০১৬ সালে সাইবার হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার রিজার্ভ চুরি হয়। এটি বিশ্বব্যাপী ব্যাংক খাতের একটি বড় চুরির ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। ঘটনার পর থেকে দেশে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। তবে ব্যাংকগুলো এখনও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গ্রাহকদের মধ্যে সাইবার হামলা ও নিরাপত্তা বিষয়ে সম্যক ধারণা নেই। বিআইবিএমের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, সাইবার হামলায় ব্যাংকের ১৬ শতাংশ কর্মীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। অর্থাৎ বাইরের হ্যাকারদের পাশাপাশি ব্যাংকের ভেতর থেকেও সাইবার হামলার ঝুঁকি রয়েছে।
দেশের ব্যাংকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সাইবার হামলা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অ্যাডভান্সড পারসিসট্যান্ট থ্রেট (এপিটি), দুর্বলতা বা নন-ভালনারেবিলিটি, ম্যালওয়্যার হামলা, ম্যালিশিয়াস টার্মিনাল, ক্রস-সাইট স্ক্রিপ্টিং (এক্সএসএস), এসকিউএল ইনজেকশন, ব্যাকডোর ইনস্টলেশন, স্পিয়ার ফিশিং, র্যানসমওয়্যার, রুটকিট, ক্লিকজ্যাকিং, ডিডিএস ইত্যাদি। অধিকাংশ হামলা ঘটে সুইফট পদ্ধতি এবং ব্যাংকের সফটওয়্যারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে। এসব হামলার মূল কারণ প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব।
এক দিকে উন্নত প্রযুক্তি কাঠামোর ঘাটতি আছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবলও কম। ফলে ব্যাংকগুলোতে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। অনেক ব্যাংকে হালনাগাদকৃত সাইবার নিরাপত্তা সংক্রান্ত হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার নেই। আর হালনাগাদকৃত সফটওয়্যার ব্যবহার হলেও আইটি কর্মীরা যথেষ্ট দক্ষ নয়। সাইবার নিরাপত্তায় অপ্রতুল বরাদ্দও বড় কারণ। তাছাড়া ব্যাংক খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার জন্য কোনো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান না থাকা দায়বদ্ধতা আরও বাড়াচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে।
পাশের দেশ ভারত ১৯৯৬ সালে ‘ইনস্টিটিউট ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিসার্চ ইন ব্যাংকিং টেকনোলজি (আইডিআরবিটি)’ নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এটি মূলত ব্যাংক খাতের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও গবেষণাভিত্তিক প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। দেশের ব্যাংক খাত নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে আইডিআরবিটির মতো একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সুপারিশ করছেন কিন্তু এ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান শুধু স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ নয়, বরং ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেশন, অনার্স-মাস্টার্স এবং গবেষণাভিত্তিক প্রোগ্রাম চালাবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতা না বাড়ালে ব্যাংক খাতের সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতি ব্যাংকের অস্তিত্বকেও সংকটে ফেলতে পারে। সঙ্গে জনমনে আস্থা কমে গেলে ব্যাংক খাতের সার্বিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। বিগত সময়ে সীমাহীন লুটপাটের কারণে ইতিমধ্যেই গ্রাহকের আস্থা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ডিজিটাল ব্যাংকিং টেকসই করতে হলে গ্রাহকের আস্থা ফেরানো অতীব জরুরি। গ্রাহক চাইছেন তাদের তথ্য, অর্থ ও পরিচয় সুরক্ষিত থাকুক। এজন্য ব্যাংকগুলোকে সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্তের ক্ষমতা বাড়াতে হবে, তাৎক্ষণিক নোটিফিকেশন চালু করতে হবে এবং প্রতারণার অভিযোগে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
সর্বশেষ ব্যাংক খাতে সাইবার নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ কর্মীর মাধ্যমে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা জোরদার করা জরুরি। পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়ানোও প্রয়োজন। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর আইটি বাজেটের বড় অংশ হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারে ব্যয় হয়। নিরাপত্তায় বরাদ্দ করা হয় মাত্র ৫ শতাংশের মতো। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সচেতনতা বাড়ানো। ব্যাংকে সাইবার অপরাধ কীভাবে সংঘটিত হয় তা জানাতে হবে। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে গ্রাহককেও সচেতনতা কর্মসূচির আওতায় আনা অপরিহার্য।

