বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন। বাংলাদেশ-চীনের বার্ষিক আমদানি-রপ্তানি ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবুও, চীনের কোনো ব্যাংক এখনও দেশে নেই। ভারতের, পাকিস্তানের ও যুক্তরাজ্যের কয়েকটি ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও চীনের ব্যাংক না থাকায় ব্যবসায়ীরা নানা অসুবিধার মুখোমুখি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের মধ্যে একটি চীনা বাণিজ্যিক ব্যাংক থাকলে ইউয়ানে লেনদেন সরাসরি করা যাবে। এতে ডলার সাশ্রয় হবে এবং লেনদেনের খরচ কমে যাবে। তবে অর্থনীতিবিদের মতে, ব্যাংক আসলেও কার্যকারিতা নির্ভর করবে কী সেবা দেওয়া হবে তার ওপর। এছাড়া ইউয়ানের সীমিত মজুতও একটি সীমাবদ্ধতা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের চীনা দূতাবাসে ইতিমধ্যেই একটি পূর্ণাঙ্গ চীনা বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য দ্রুত বেড়েছে। গত দশ বছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য তিন গুণ বেড়ে গেছে। দেশের মোট আমদানি-র ২৬ শতাংশ আসে চীন থেকে। তবে রপ্তানি মাত্র ১ শতাংশের বেশি। দেশে চীনের অর্থায়নে নানা প্রকল্পও চলছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে চীনের পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ খরচ করেছে ১৬.৬৪ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে চীনে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ০.৪১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। মেগা প্রকল্প যেমন পদ্মা সেতু, রেল সংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনের অর্থায়ন রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন চীনের সঙ্গে লেনদেন তিন স্তরে হয়। প্রথমে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ব্যাংককে টাকায় পরিশোধ করেন। ব্যাংক তা ডলারে রূপান্তর করে চীনের ব্যাংককে দেয়। চীনের ব্যাংক আবার ডলারকে ইউয়ানে রূপান্তর করে রপ্তানিকারককে দেয়। এতে অতিরিক্ত বিনিময় খরচ হয়।
চীনা ব্যাংক থাকলে সরাসরি ইউয়ানে লেনদেন সম্ভব হবে। এতে লেনদেন খরচ ২-৩ শতাংশ কমে যাবে। ডলারের সংকট ও দাম বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিও কমবে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, রপ্তানি ও প্রকল্প সহযোগিতার মাধ্যমে ২-৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ইউয়ান দেশেই রাখা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে ডলারের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। ইউয়ানের দাম বেড়েছে মাত্র ২৭ শতাংশ। ২০২০ সালে ডলার ৮৪-৮৫ টাকায় থাকলেও ২০২২ সালের মাঝামাঝি তা ১০৭ টাকায় পৌঁছায়। বর্তমানে ১২২ টাকার বেশি। ইউয়ান ২০২০ সালে ছিল ১৩.৪৮ টাকা, যা এখন ১৭.২২ টাকা। দেশে বর্তমানে ৬টি দেশের ৯টি বিদেশি ব্যাংক কাজ করছে। যুক্তরাজ্যের দুটি, পাকিস্তানের তিনটি, অন্য দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও শ্রীলঙ্কার একটি করে ব্যাংক রয়েছে।
বিসিসিসিআই সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা চীনের একটি ব্যাংকের প্রয়োজন অনুভব করছি। তাই চীনা দূতাবাসে প্রস্তাব দিয়েছি। তারা আগ্রহ দেখিয়েছে।’ সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বিসিসিসিআই ছয়টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম দাবি, বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ চীনা বাণিজ্যিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা।
বিসিসিসিআইয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বলেন, ‘আমাদের হাতে ইউয়ানের মজুত কম থাকলেও চীনের বিভিন্ন প্রকল্পের হিসাব মিলিয়ে ২-৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ইউয়ান থাকে। চীনা পণ্য আমদানি ৩ বিলিয়ন ডলার ইউয়ানে পরিশোধ করলে রিজার্ভের চাপ কমবে।’ তিনি বলেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরে চীনা ব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে চীনের দূতাবাসকে জানানো হয়েছে। দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায়ে কিছু আলোচনাও হয়েছে। তবে কেন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই, তা জানা নেই। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর সুযোগ আছে। ব্যাংক থাকলে লেনদেন আরও সহজ হবে। ইউয়ানের ঘাটতি থাকলেও ডলারে লেনদেন করা সম্ভব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘চীনের ব্যাংক থাকাটা স্বাভাবিক। তবে এখনও কোনো প্রস্তাব আসেনি। আসলে আমরা বিবেচনা করব।’ জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘চীনের ব্যাংক কতটুকু সুবিধা দেবে, তা নির্ভর করবে তাদের সেবার ওপর। আগে তাদের আগ্রহ প্রয়োজন। ইউয়ানে লেনদেন খুব প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ হাতে অত ইউয়ান নেই।’

