গত ৩০ অক্টোবর ২০২৫ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি-এর বোর্ড মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পরিচালনা পর্ষদের ১১ জন সদস্য। সভায় সম্প্রতি প্রকাশিত এমডি হাবিবুর রহমান সংক্রান্ত ধারাবাহিক রিপোর্ট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও তার পূর্ববর্তী ব্যাংক—মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক—সংক্রান্ত বিভিন্ন ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থপাচারের অভিযোগ বিস্তারিতভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা হয়।
হাবিবুর রহমান এস আলমের অনুকূলে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে ২৬০৭ কোটি টাকার লুটপাট ও অর্থপাচারের, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে ৮ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি মামলায় অভিযুক্ত এবং চার্জশিটভুক্ত প্রধান আসামিদের একজন। গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও তিনি জামিনে থেকে বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ের মহলের সহায়তায় এমডির আসনে অবস্থান করেছিলেন।
বোর্ড মিটিংয়ের পর ছয়জন পরিচালকের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে হাবিবুর রহমানকে ৯০ দিনের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল আজিজের স্থলে তার পুত্র, ভাইস চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল আলিমকে বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
ইউনিয়ন ব্যাংকের ২৬০৭ কোটি টাকার কেলেঙ্কারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ-৭ পরিদর্শন রিপোর্টে হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিরূপ পর্যবেক্ষণ থাকায় বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয়, ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্ট ১৯৯১-এর ১৫(৫) ধারা ও BRPD সার্কুলার-৫ অনুযায়ী তার এমডি পদে থাকার যোগ্যতা নেই। এজন্য তাকে এমডি পদ থেকে অপসারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি চাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়।
বোর্ডের এই সিদ্ধান্তসমূহ ছয়জন পরিচালকের স্বাক্ষরে তাৎক্ষণিকভাবে ইমেইলের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে এই ছয়জন পরিচালক সশরীরে বাংলাদেশ ব্যাংকে উপস্থিত হয়ে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ ও নীতি বিভাগ-তে জমা দেন এবং গভর্নর মহোদয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে বিষয়টি মৌখিকভাবে জানান।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ৯০ দিনের ছুটি ঘোষণার পরও হাবিবুর রহমান অবৈধভাবে প্রতিদিন অফিসে উপস্থিত হচ্ছেন এবং এমডি হিসেবে বিভিন্ন কাগজপত্রে সই করছেন। এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হাবিবুর রহমানের বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার কল ও টেক্সট করা হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে জানার পরও কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তা প্রশ্ন তোলার মতো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, “তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
হাবিবুর রহমানের অবৈধভাবে এমডির পদে থাকা এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রহস্যময় নীরবতার কারণে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এখন গভীর সংকটে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ আমানতকারী উদ্বিগ্ন এবং আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে দেড় দশক ধরে ব্যাংকিং করছেন এক আমেরিকা প্রবাসী গ্রাহক। তিনি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের প্রিন্সিপাল ও বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় রক্ষিত কয়েক কোটি টাকার আমানত নিয়ে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, হাবিবুর রহমান ইউনিয়ন ব্যাংকে কর্মরত থাকাকালে এস আলম গ্রুপের অনুকূলে ২৬০৭ কোটি টাকার অনিয়মিত ঋণ অনুমোদনে সরাসরি জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তকারীরা এমন প্রমাণও পেয়েছেন যে, তার নেতৃত্বে একাধিক ভূয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ-৭-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১-২২ সালে ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের নামে পরিচালিত প্রায় ৩০টি ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিটি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৩ কোটি থেকে ১৪৮ কোটি টাকা, যার মোট যোগফল দাঁড়ায় ২৬০৭ কোটি টাকা। ঋণগুলো বর্তমানে সম্পূর্ণ খেলাপি এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি।
রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউনিয়ন ব্যাংকের তৎকালীন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিনিয়োগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান এসব ঋণ অনুমোদনে “সরাসরি ভূমিকা” রাখেন। ঋণ প্রস্তাবের অফিস নোটে তার স্বাক্ষর পাওয়া গেছে, যা “প্রধান কার্যালয়ের প্রথম ও শেষ অনুমোদন” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আরেক বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, হাবিবুর রহমান ২০১২ সালে যমুনা ব্যাংকে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিভাগ বিভাগের প্রধান থাকাকালীন তৎকালীন ডিএমডি মোজাম্মেল হোসেনের নির্দেশ অমান্য করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। একক সিদ্ধান্তে তিনি বিসমিল্লাহ তাওয়েল গ্রুপকে প্রায় ৪২.১১ কোটি টাকার অনৈতিক ঋণ সুবিধা দেন। পরে ১৩.০৬.২০১৩ তারিখে হাবিবুরকে বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য তলব করা হলেও কিছু দিনের মধ্যে তিনি সুকৌশলে যমুনা ব্যাংক ত্যাগ করেন।
হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চার্জশীটও রয়েছে। ২০০০ সালে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ক্রেডিট বিভাগে দায়িত্বে থাকাকালে তিনি “প্যাট্রিক ফ্যাশনস” নামের এক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ গোপন করে নতুন করে আট কোটি টাকার ঋণ অনুমোদনের জন্য মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছিলেন। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলা দায়ের হয়। মামলাটি বর্তমানে মেট্রো স্পেশাল কোর্টে (মামলা নং ২৭২/২২) বিচারাধীন। উল্লেখ্য, এই মামলার অভিযুক্ত ও চার্জশিটভুক্ত হাবিবুর বর্তমানে আগাম জামিনে রয়েছেন।
দুদকের মামলায় চার্জশীটভুক্ত আসামি হওয়ার পর ২০২৪ সালে হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংককে ৬০ দিনের মধ্যে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন (রিট নং ৫২১৭/২০২৪)। এর পরপরই হাবিবুর রহমান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করেন, যা বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন দেয়। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ ও নীতি বিভাগ-এর দায়িত্বে ছিলেন মিসেস নুরুন নাহার।
কিন্তু অল্প কয়েক মাসের মধ্যে ব্যাংক লুটপাটে এস আলম গ্রুপকে সহযোগিতা করার “পুরস্কার” হিসেবে আগস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশ ব্যাংক পুনরায় তাকে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়। এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে চার্জশীটভুক্ত ও পালাতক আসামীর এমডি পদে আসীন হওয়ার একমাত্র ও সর্বশেষ ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল আজিজকে তখন বিআরপিডি’র দায়িত্বে থাকা ডেপুটি গভর্নর মিসেস নুরুন নাহার নিজে ফোন করে হাবিবুরকে এমডি হিসেবে পুনর্নিয়োগের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রণ ও নীতি বিভাগ সার্কুলার-৫-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, বরং ব্যাংকের এমডি নিয়োগ, বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো ও চাকরিচ্যুতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নিজের আগের সিদ্ধান্তের সঙ্গেও বিরোধ সৃষ্টি করে।
এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত ব্যাংক খাতে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। একই মামলায় চার্জশীটভুক্ত অন্য আসামি মো: রবিউল ইসলামকে প্রথমে এনআরবিসি ব্যাংক ও পরবর্তীতে এসবিএসি ব্যাংকেও এমডি পদে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে নীরবতা ও দেউলিয়াত্বকে সামনে আনে।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের একাধিক ভেতরের সূত্র জানায়, পুনঃনিয়োগের পর থেকেই হাবিবুর রহমান “অস্বাভাবিক ক্ষমতার প্রভাব” বিস্তার করেছেন। তিনি কয়েক মাসের মধ্যে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেআইনি ও অযৌক্তিকভাবে চাকরিচ্যুত বা জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। অন্যদিকে, ইউনিয়ন ব্যাংকের সময়কার কিছু বিতর্কিত কর্মকর্তাকে পুনরায় স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংকের বর্তমান মানবসম্পদ প্রধান মনসুর আহমেদ এবং প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন। এই দুজনও ইউনিয়ন ব্যাংকের বিনিয়োগ কমিটির সদস্য ছিলেন এবং ভূয়া ঋণ অনুমোদনে সরাসরি জড়িত ছিলেন। সম্প্রতি দুদক তাদেরকে ব্যাংকের অর্থপাচারের গুরুতর অভিযোগ তদন্তে তলব করেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন বলেন, “একজন চার্জশীটভুক্ত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্টে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আবারও এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট তৈরি করে এবং নীতি নির্ধারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে।”

