বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের পর পাঁচ ইসলামী ধারার দুর্বল ব্যাংকের শেয়ার সম্প্রতি ‘শূন্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে এক ঝটকায় প্রায় ৬,০০০ কোটি টাকার সম্পদ মুহূর্তে উধাও হয়ে গেছে।
১০ টাকা ফেসভ্যালুতে পাঁচ ব্যাংকের মোট ৫৮১ কোটি ৯৫ লাখ ৭১ হাজার ৯৫৯টি শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৫,৮১৯ কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তাঁদের হাতে থাকা ২১৯ কোটি ৮৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬৪টি শেয়ারের বিনিয়োগমূল্য ছিল ২,২০০ কোটি টাকা। এই বিনিয়োগ মুহূর্তেই পোর্টফোলিও থেকে মুছে গেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ছিল ২২৪ কোটি ৪০ লাখ ৩৭ হাজার শেয়ার। এর বাজারমূল্য দাঁড়াচ্ছিল ২,২০৩ কোটি ৭ লাখ টাকা। উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে ছিল ১৪৩ কোটি ২ লাখ ৭৫ হাজার শেয়ার, যার মূল্যমান ছিল ১,৩৯০ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে থাকা ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৯০ শেয়ারের দামও ছিল ২৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
সব মিলিয়ে এই বিশাল বিনিয়োগ এক মুহূর্তে আর্থিক মূল্যহীন হয়ে গেছে। সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সব ধরনের বিনিয়োগকারীই এই ক্ষতির প্রভাবে অর্থনৈতিকভাবে অসুবিধায় পড়েছেন। এসব ব্যাংকের মালিক, পরিচালক ও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তবে এ সংকট কোনো একদিনের সৃষ্টি নয়। এটি বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি, পরিচালকদের অনিয়ম ও ঋণ কেলেঙ্কারির ফল। তবু দায়ভার এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাঁধে চাপানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ক্ষতি শুধুই কোনো একক বিনিয়োগকারীর নয়। শেয়ারবাজারে আস্থা কমবে, বিনিয়োগের প্রবাহ স্থবির হবে এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে কাঁপন ছড়িয়ে পড়বে। নিঃস্বতা, ক্ষতির তীব্রতা এবং অর্থের হঠাৎ উধাও—সব একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। এর প্রভাব অর্থনীতির ভবিষ্যতের ওপর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যাবে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত করে প্রশাসক নিয়োগ করেছে। এই ব্যাংকগুলো হলো: ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক। বিনিয়োগকারী মো. মহসিন বলেন, “একীভূত হওয়া ব্যাংকে বিনিয়োগকারীর শেয়ার ফিরিয়ে দিতে হবে। লুটের দায় কেন সাধারণ মানুষকে নিতে হবে?” অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, “যারা ব্যাংক লুট করেছে, তাদের দায়ভার এখন সাধারণ বিনিয়োগকারীর ওপর চাপানো হচ্ছে। এটি আর্থিক অন্যায়ের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।”

বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, শেয়ারহোল্ডারদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। গভর্নরের ভাষ্য, “পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ইকুইটির মূল্য নেতিবাচক ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশ। এখন তা আদায় করা উচিত। তবে তা না করে শূন্যের নিচের শেয়ারগুলোর মূল্য জিরো হিসেবে ধরা হবে।” আইন ও বাস্তবতার মধ্যে ছেদও চোখে পড়ে।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও হিসাববিদ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, “আইন অনুযায়ী, কোম্পানি অবসায়ন বা মার্জারের পর সম্পদ বিক্রি করে দায়-দেনা শোধের পর যদি কিছু থাকে, শেয়ারহোল্ডাররা পাবেন। এখানে তো কিছুই নেই।” তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরকার চাইলে সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য কিছু উদ্যোগ নিতে পারে।
অর্থনৈতিক চিত্র ভয়াবহ:
পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের সম্মিলিত মূলধন ঘাটতি ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকায়। এর মধ্যে বড় শিল্পগোষ্ঠীর লুট ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ (একিউআর) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোট আমানত ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৮ কোটি, মোট ঋণ ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮৪ কোটি, আর খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। গড় খেলাপি ঋণ ৭৭ শতাংশ।
ঋণের অনুপাত ব্যাংকভিত্তিক ভিন্ন। ইউনিয়ন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ৯৮ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৯৬ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ৯৫ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ৬২ শতাংশ, এক্সিম ব্যাংক ৪৮ শতাংশ।
শেয়ার বিন্যাসও হতাশাজনক। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ার ৭৮ কোটি ৫৮ লাখ, যার মূল্য ৭৮৫ কোটি টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে সাধারণের শেয়ার ২১ কোটি, মূল্য ২১৪ কোটি। এক্সিম ব্যাংকে ৫৬ কোটি ৯০ লাখ, দাম ৫৬৯ কোটি। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৩০ কোটি ৮৯ লাখ, দাম ৩০৮ কোটি। ইউনিয়ন ব্যাংকে সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ার ৩৩ কোটি ২ লাখ, দাম ৩৩০ কোটি টাকা। গত দুই বছরে এই ব্যাংকের শেয়ার মূল্যের ওঠানামা ১০-১৩ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে ক্ষতি আরও গভীর এবং বিনিয়োগকারীর হতাশা তীব্র।

