দেশের ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণের তীব্র বৃদ্ধির কারণে বৈশ্বিকভাবে নেতিবাচক মনোভাবের মুখোমুখি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো খেলাপি ঋণের এই ঊর্ধ্বগতিকে সতর্কতার চোখে দেখছে। ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে দেশের ব্যাংক খাতের রেটিং কমিয়ে দেওয়া হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)ও খেলাপি ঋণের এই দ্রুত বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বড় ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন বা বৈদেশিক ঋণের গ্যারান্টি দিতে সতর্কতা অবলম্বন করছে। তারা লেনদেনের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক নিরাপত্তা যাচাই করছে।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। লুটের বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। এই ঋণ এখন আর আদায় হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকগুলো এই ঋণকে খেলাপি হিসাবে শ্রেণিকরণ করছে। পূর্বে খেলাপি হওয়া ঋণকে গোপন রাখা হয়েছিল। এজন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি কম দেখানো হয়েছিল।
গত ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছেছিল। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে লুটপাটের চিত্র প্রকাশ পেতে শুরু করে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে ৬ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ব্যাংকের ৩ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ঝুঁকিমুক্ত ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ থাকলে ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করে। বর্তমানে সব স্থানীয় ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের ওপরে।
দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যস্থতায় সম্পন্ন হয়। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঋণ লেনদেনও বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে হয়। বিদেশি ব্যাংক লেনদেনের আগে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা যাচাই করে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি এই তিন সূচক বেশি বিবেচনায় থাকে। দেশের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যাংকের এই তিন খাতের অবস্থা খারাপ।
এ অবস্থায় বিদেশি ব্যাংকরা নির্ধারিত সময়ে পণ্যের অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা চায়। কখনও অতিরিক্ত গ্যারান্টিও দিতে হচ্ছে। এতে আমদানি পণ্যের খরচ ও দাম বেড়ে যাচ্ছে। ব্যবসার ব্যয় বাড়ছে, ভোক্তার ওপর চাপ বাড়ছে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। অতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে বৈশ্বিক ঋণমান নির্ণায়ক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে সতর্ক করছে। তারা আশঙ্কা করছে, ঋণমান কমে গেলে বিদেশি ব্যাংক লেনদেনে নিরুৎসাহিত হবে, বাড়তি গ্যারান্টি চাইবে এবং সুদের হার বাড়াবে। এতে দেশের আর্থিক খাতের সুনাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০২৬ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ৫ শতাংশে নামাতে হবে। তবে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলো ঋণের ঊর্ধ্বগতিকে ইতিমধ্যেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছে। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের ঋণমান হ্রাসের আশঙ্কা তৈরি করছে।

