ডলারের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও, চলতি বছরের আগস্টে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি কমেছে। এর মূল কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি হ্রাস, যা নতুন ব্যবসা ও বিনিয়োগে মন্দার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে আমদানি দায় নিষ্পত্তি কমে ৪.৮৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছরের একই মাসে এই পরিমাণ ছিল ৫.৪৮ বিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১০.৯৪ শতাংশ। তবে আগস্টে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ বেড়ে ৩.০৬ শতাংশ, যা ৫.৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এক বছর আগে এই পরিমাণ ছিল ৫.২২ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পূর্ববর্তী মাসগুলোতে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ কম ছিল। এছাড়া ওভারডিউ এলসির চাপ কম থাকার কারণে আগস্টে এলসি নিষ্পত্তিও কমেছে। দেশে নতুন ব্যবসা ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখন কাঁচামাল বা মূলধনী যন্ত্রপাতির চেয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানি বেশি করছেন। একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বিনিয়োগ কমলে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও কমে যায়। বর্তমানে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকছেন কম। এছাড়া ডেফারড [বিলম্বিত] এলসিগুলোর মেয়াদও আর বাড়ানো হচ্ছে না।’
পলিসি থিঙ্ক অ্যান্ড ইকোনমিক রিসার্চ সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. মাজেদুল হক বলেন, ‘ভোগ্যপণ্য ছাড়া সেভাবে এলসি খোলা হচ্ছে না। বিনিয়োগ কম হওয়ায় কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতির চাহিদাও কমেছে। বেসরকারি খাতে ঋণ কমেছে, নতুন বিনিয়োগ নেই এবং ব্যাংকঋণের সুদহারও উচ্চ। এ বাস্তবতায় ভোগ্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য আমদানি স্বাভাবিকভাবেই কম।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সেখানে এলসি নিষ্পত্তি কমেনি। ‘মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে যাওয়ায় এলসি নিষ্পত্তি কমেছে। বেসরকারি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি ৬-৭ শতাংশে সীমিত থাকায় এ বিষয়টি স্পষ্ট,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ১১.৫ শতাংশ কমেছে। এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান বলেন, ‘মূলত আগে এলসি কম খোলা হওয়ার কারণে নিষ্পত্তি কমেছে। ২০২৪ সালের শেষ ও চলতি বছরের শুরুতে এলসি খোলার পরিমাণ অনেক কম ছিল। এজন্য আগস্টে নিষ্পত্তি কমে গেছে।’
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশের ডলারের বাজার অস্থির হয়। বাজার স্থিতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক তখন এলসি খোলার ওপর মার্জিন আরোপ করে। পরবর্তীতে পর্যাপ্ত ডলারের অভাবে এলসি নিষ্পত্তিতে ব্যাংকগুলো ওভারডিউয়ের সমস্যার মুখোমুখি হয়। ২০২৪ সালে দেশের শিল্প-বাণিজ্য গতিশীল করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্যের এলসিতে মার্জিন তুলে দেয়। তখন থেকে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্কের ভিত্তিতে নগদ মার্জিন ছাড়াই এলসি খোলার সুযোগ পাচ্ছেন। ড. মাজেদুল হক সতর্ক করে বলেন, বিনিয়োগ কম থাকলে বেকারত্ব বাড়তে পারে। এতে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ডলারের সরবরাহ যথেষ্ট। এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নেই। তিনি আরও বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে নতুন বিনিয়োগের আশাও দেখা দিতে পারে।’

