দেশের ব্যাংকিং খাত দীর্ঘদিন ধরে নানা বিতর্ক ও প্রশ্নের মুখোমুখি। খেলাপি ঋণ, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, তথ্যপ্রযুক্তির অভাব এবং ব্যবস্থাপনার সংকটের কারণে জনসাধারণের আস্থা ক্রমেই কমছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন ধরনের ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্স প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও এ পদক্ষেপ ভবিষ্যৎমুখী, তবে এর যৌক্তিকতা ও সময়োপযোগিতা নিয়ে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডিজিটাল ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। এর মাধ্যমে শাখায় গিয়ে হিসাব খোলার প্রয়োজন নেই; শুধু মোবাইল ফোন থাকলেই গ্রাহক হতে পারবেন মানুষ। তবে প্রচলিত ব্যাংকগুলোতেই যদি প্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তা দুর্বল থাকে, সেখানে সম্পূর্ণ অনলাইন ভিত্তিক ব্যাংক চালু করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক এখনো আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী আইটি নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। পিসিআই-ডিএসএস বা আইএসও সার্টিফিকেশন অনেক ব্যাংকই অর্জন করতে ব্যর্থ। ফলে অনলাইন প্রতারণা, হ্যাকিং ও তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আর যদি এমন অবস্থায় ডিজিটাল ব্যাংক চালু করা হয়, তা ভবিষ্যতে বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক হলেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তি খুবই কম। ডিজিটাল ব্যাংক ‘আন্ডার ব্যাংকড’ জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার সুযোগ দিতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি ডিজিটাল ব্যাংক শুধুই প্রচলিত ব্যাংকের গ্রাহকগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে, তবে নতুন কিছু যুক্ত হবে না; শুধু প্রযুক্তির আধুনিকায়ন হবে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে তেমন উন্নতি হবে না।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ডিজিটাল ব্যাংক চালুর আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাল্টিস্টেপ অথেন্টিকেশন, শক্তিশালী এনক্রিপশন, রিয়েল টাইম ফ্রড মনিটরিং ও আন্তর্জাতিক মানের সিকিউরিটি প্রটোকল নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ডিজিটাল ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকের বিকল্প নয়, বরং এটি নতুন ধরনের সেবা প্ল্যাটফর্ম। এটি মূলত সেই জনগোষ্ঠীর জন্য তৈরি হবে, যারা এখনও ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে। আবেদনকারীদের জন্য কঠোর প্রযুক্তি ও ফিনটেক মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা যাচাই করা হবে।
তবে আগের সরকারের সময়ে ‘নগদ’ ও ‘কড়ি’ নামে দুই প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়ায় জটিলতা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে জানা গেছে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কিছু ‘ভৌতিক’ কোম্পানির সম্পৃক্ততা ছিল। বিশেষ করে নগদ ‘ডিজিটাল কারেন্সি’ ইস্যু ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে কার্যকর ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এমন পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
এছাড়া দেশের গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা এখনও পর্যাপ্ত নয়। অনলাইন লেনদেন সম্পর্কে অনেক গ্রাহকই সচেতন নন। এই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডিজিটাল ব্যাংকিং চালুর আগে প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা দূর করা জরুরি।
ডিজিটাল ব্যাংক অবশ্য ভবিষ্যতের পথ দেখাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশে এটি সফলভাবে চালু হয়েছে, যেখানে গ্রাহকরা স্বল্প ব্যয়ে, দ্রুত এবং আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই পথে ধাপে ধাপে এগোনো সম্ভব। তবে এজন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত পরিকল্পনা, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। তাড়াহুড়া করে লাইসেন্স প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে শুধু নতুন ব্যাংক নয়, বরং পুরো আর্থিক খাতের জন্য নতুন ঝুঁকি ডেকে আনা।
ডিজিটাল ব্যাংক একটি সময়োপযোগী উদ্যোগ হতে পারে, তবে তার সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের সংযমী পরিকল্পনা। শুধুমাত্র এগুলো নিশ্চিত হলে এটি দেশের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ও আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।

