বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পুরনো শহর সৈয়দপুর— একসময় যেখানে রেলওয়ে ওয়ার্কশপের শহর হিসেবেই পরিচিত ছিল, আজ সেই শহরই নতুনভাবে জেগে উঠছে লোহা পুনর্ব্যবহার শিল্পের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পরিত্যক্ত লোহা এখানকার শত শত কারখানায় নতুন রূপ পাচ্ছে— তৈরি হচ্ছে রেল, কৃষি, মোটরযানসহ নানা শিল্পের যন্ত্রাংশ।
উদ্যোক্তাদের হিসেবে, এই লোহা পুনর্ব্যবহার শিল্পে এখন বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। যা শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকেই চাঙা করছে না, বরং হাজারো মানুষের জীবিকার চাকা ঘুরিয়ে দিচ্ছে।
সৈয়দপুর শহরজুড়ে ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ২০০টির মতো কারখানা দিনরাত ব্যস্ত এই কাজে। পুরনো জাহাজ, ট্রাক, গাড়ি বা শিল্পকারখানার পরিত্যক্ত লোহা ট্রাকে করে এখানে আসে, আর শ্রমিকেরা তা গলিয়ে বানাচ্ছেন কানেক্টিং রড, হাউজিং, হোস পাইপ, ইঞ্জিনের ঢাকনা, নাট, বেয়ারিং কভার, এমনকি রেলকোচের দরজা-জানালাও।
কারখানাগুলোতে এখন কাজ করছেন ৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। স্থানীয় এক শ্রমিক বলেন,
“আগে ঢাকায় কাজ করতাম, এখন নিজের শহরে থেকেই উপার্জন করছি। পরিবার ভালো আছে— এই শিল্পই আমাদের জীবিকা।”
একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন ২০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত পাটোয়ারী নামের এক কর্মী। তার ভাষায়,
“এখন আমাদের শহরে প্রায় সব ধরনের যন্ত্রাংশই তৈরি হয়। বাইরে থেকে আনতে হয় না।”
স্থানীয় উদ্যোক্তা নাঈম খান, যিনি নাঈম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেন, বলেন—
“বাইরে কাজ শিখে এসে নিজ শহরে কারখানা গড়েছি। ৫০ জন শ্রমিক কাজ করে আমার কারখানায়। আমরা রেলের ইঞ্জিন ছাড়া প্রায় সব যন্ত্রাংশই তৈরি করতে পারি।”
আরেক উদ্যোক্তা আব্দুল মালেক, মালিক বিসমিল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, জানান—
“আমরা সরকারি টেন্ডারের কাজও করি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নকশা অনুযায়ী যন্ত্রাংশ তৈরি করতে হয়।”
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সৈয়দপুর শাখার সভাপতি এরশাদ হোসেন পাপ্পু বলেন,
“এই শহরে এখন ২০০টিরও বেশি কারখানা চলছে। কয়েক হাজার মানুষের জীবিকার উৎস এটি। বছরে ৩০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। সরকার যদি প্রণোদনা বা সুদমুক্ত ঋণ দেয়, তাহলে এই শিল্প আরও বড় আকারে গড়ে উঠবে।”
বিসিক শিল্পনগরীর কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান,
“রেলওয়ে যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান আমাদের দপ্তরে নিবন্ধিত আছে। তারা নিয়মিত সরকারি টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ করছে। এর বাইরে আরও অনেক অনিবন্ধিত ছোট-বড় কারখানাও সক্রিয়।”
একসময় যেখানে পরিত্যক্ত লোহা মানে ছিল অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য, আজ সেই লোহাই সৈয়দপুরে নতুন স্বপ্নের চাকা ঘুরাচ্ছে। স্থানীয়দের আশা, সরকারি সহায়তা ও আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এই শিল্প একদিন দেশের অন্যতম রপ্তানিযোগ্য খাতে পরিণত হতে পারে।

