বাংলাদেশ এখন রাশিয়ার চেয়ে প্রায় ৮০ ডলার বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কিনছে। রাশিয়ার গম তুলনামূলকভাবে সস্তা হলেও সরকার বলছে—এটা শুধু দামের হিসাব নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা এবং রপ্তানি বাজার ধরে রাখার কৌশল।
চট্টগ্রাম বন্দরে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা প্রথম চালান হিসেবে ৫৭ হাজার টন গম এসে পৌঁছেছে। এটি ৪ লাখ ৪০ হাজার টন গম কেনার চুক্তির অংশ। প্রতি টন গমের দাম পড়ছে ৩০৮ মার্কিন ডলার, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে রাশিয়ান গম বিক্রি হচ্ছে ২২৬ থেকে ২৩০ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি টনে পার্থক্য ৭৫ থেকে ৮০ ডলার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই আমদানি কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্য অধিদপ্তরের এক সমঝোতা স্মারকের আওতায় চলছে। এর পেছনে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপটও আছে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার—যেখানে বছরে বাংলাদেশ ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য রপ্তানি করে। সরকারের লক্ষ্য এই বাজারকে আরও সম্প্রসারিত করে ১০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া। সেই তুলনায় রাশিয়ায় রপ্তানি এখনো ১ বিলিয়ন ডলারও ছুঁয়নি।
তিনি বলেন, “আমরা শুধু গম কিনছি না; এটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের অবস্থানকে আরও মজবুত করার একটি অংশ। এই সম্পর্ক বজায় রাখতে কিছু ছাড় দেওয়া যৌক্তিক।”
তাঁর মতে, রাশিয়ান গম সস্তা হলেও সেখানে সরবরাহের ঝুঁকি বেশি। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া যেকোনো সময় রপ্তানি বন্ধ করতে পারে। আবার রাশিয়ান গমে আর্দ্রতা ও পোকামাকড়ের সমস্যা থাকায় ১২ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়।
বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের গমের প্রোটিনের মান ও সংরক্ষণক্ষমতা বেশি। ফলে এটি নিরাপদ এবং কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়। আর রাশিয়া বা ইউক্রেনের মতো অনিশ্চিত উৎসের ওপর সরকারি খাদ্য মজুত নির্ভর করাটা ঝুঁকিপূর্ণ।
অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চাইলে রাশিয়া থেকে কম দামে গম আনতে পারে, তবে সরকারি পর্যায়ে কেনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে—মূলত কৌশলগত কারণে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, “আমরা সবসময় দামের প্রতিযোগিতা বিবেচনা করি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের গমের মান ভালো, তাই দাম বেশি হলেও কিছু ক্ষেত্রে সেটিই অগ্রাধিকার পায়।”
তিনি আরও জানান, মেঘনা গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়মিত সয়াবিন আমদানি করে। বর্তমানে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে সয়াবিন কিনতে শুরু করায় মার্কিন সয়াবিনের দামও তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সময় বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্কহার ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হয়। শর্ত ছিল, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্যের আমদানি বাড়াতে হবে। এই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবেই সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৩৫ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকার যে “মূল্য নয়, সম্পর্ক”–নীতিতে এগোচ্ছে, তা বাংলাদেশের রপ্তানি-নির্ভর অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক হতে পারে।

