বৈদেশিক ঋণ না পাওয়ায় দীর্ঘদিন বিলম্বিত থাকা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি এগিয়ে আনা হলে পরিশোধিত তেলের আমদানি কমবে এবং বছরে লাখ লাখ ডলার সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ইতোমধ্যে ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ (ইআরএল-২)’ প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব কমিশনে জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মোট ব্যয় এখন ৪২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩০ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে দেবে এবং ১২ হাজার ৪৭৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা আসবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে। প্রকল্পের সম্পূর্ণ কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০৩০ সালের জুনে। বৈদেশিক অর্থায়ন না পাওয়ায় দীর্ঘদিন বিলম্বিত থাকা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৬৬০০ কোটি টাকা হয়েছে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি বিভাগ প্রকল্পটির মোট ব্যয় ৩৬ হাজার ৪১০ কোটি টাকা ধরে বিদেশি অর্থায়নের চেষ্টা করেছিল। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ এবং ১০ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু আট মাসে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৯৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বৈদেশিক বা বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণে ধারাবাহিক ব্যর্থতা এবং ক্রমবর্ধমান নির্মাণ ব্যয়ের কারণে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এক কর্মকর্তা বলেন, “আগে আমরা কম খরচে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু সময়ের সঙ্গে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। তাই সরকার দ্রুত কাজ শুরু করতে নিজস্ব অর্থায়নে এগোচ্ছে।”
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছেও ঋণের আবেদন করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতি মেলেনি। এর আগে বেসরকারিভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টাও সফল হয়নি। কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটিকে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সরকারি ও নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য অননুমোদিত নতুন প্রকল্প তালিকায় স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হলে প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে না।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফওজুল কবির খান গতকাল বলেন, “এই প্রকল্পে সরাসরি কোনো বিদেশি অর্থায়ন নেই। জীবাশ্ম জ্বালানি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর—এই কারণে উন্নয়ন অংশীদাররা তহবিল দিতে আগ্রহী হচ্ছে না।” তবে তিনি জানান, সরকার পরোক্ষভাবে এআইআইবির মতো উৎস থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। প্রকল্পভিত্তিক বিদেশি ঋণের বিপরীতে, বাজেট সহায়তার অর্থ সরকার নিজস্ব অগ্রাধিকার অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে পারবে। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, সরকার চলতি অর্থবছরে ১.৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তার জন্য ১৩ আগস্ট এআইআইবির কাছে আবেদন করেছে। ক্লাইমেট পলিসি-ভিত্তিক বাজেট সাপোর্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে পাঠানো অনুরোধে ইতোমধ্যেই ইতিবাচক সাড়া মিলেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তকে ‘বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত’ হিসেবে দেখছেন। ড. বদরুল ইমাম বলেন, “দেশে একটি আধুনিক রিফাইনারি স্থাপন অত্যন্ত জরুরি। যদি আমরা পরিশোধিত তেল আমদানি অব্যাহত রাখি, ব্যয় প্রতি বছরই বাড়বে। বিদেশি ঋণ বিনা মূল্যে আসে না—এটি ফেরত দিতে হয়। তাই সরকারের যদি সামর্থ্য থাকে, নিজস্ব অর্থায়নই ভালো অপশন।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিজস্ব তহবিলে প্রকল্পটি এগিয়ে নিলে দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি, বিদেশি ঋণের চাপ ও দীর্ঘ সময়কাল এড়িয়ে চলা যাবে। এ ধরনের বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয় যে, সরকারের পদক্ষেপ শুধু আর্থিকভাবেই নয়, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তার দিক থেকেও সুচিন্তিত।
এক দশক ধরে ঝুলে থাকা ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট:
চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি ১৯৬৮ সালে ফরাসি প্রকৌশল প্রতিষ্ঠান টেকনিপ-এর সহায়তায় নির্মিত হয়। বর্তমানে এটি বছরে মাত্র ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করতে পারে। দেশীয় চাহিদা ৭৫ লাখ টন—ফলে ব্যয়বহুল পরিশোধিত তেল আমাদানির ওপর নির্ভরতা বেড়েছে।
২০১০ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে প্রকল্পের জন্য ১৩ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়, কিন্তু দীর্ঘ সময়ে প্রকল্পটি কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পায়নি। ২০২২ সালে বিপিসি স্ব-অর্থায়নে নতুনভাবে উদ্যোগ নিলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও অর্থায়ন সংক্রান্ত সমস্যার কারণে প্রকল্পটি এগোতে পারেনি।
২০২৪ সালের শুরুতে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইআরএল-২ নির্মাণের আগ্রহ দেখালে, ৯ জুলাই জ্বালানি বিভাগ প্রস্তাবটি অনুমোদন করে, কিন্তু আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের কারণে প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বিপিসি প্রকল্পটি সচল করার উদ্যোগ নেয়। প্রথমে বিদেশি ঋণে বাস্তবায়নের চেষ্টা হলেও সাড়া না পেয়ে, এখন সরকার এবং বিপিসির নিজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের নতুন পরিকল্পনা নিয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকার সংস্থা
বৈদেশিক অর্থায়ন ব্যর্থতার পর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ৬৬০০ কোটি টাকা হয়েছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা সরকারের এই পদক্ষেপকে ‘বাস্তবসম্মত ও সময়োচিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। ড. বদরুল ইমাম বলেন, “বিদেশি ঋণ বিনা মূল্যে আসে না, তা ফেরত দিতে হয়। তাই সরকারের যদি সামর্থ্য থাকে, নিজস্ব অর্থায়নই ভালো অপশন।”
ভোক্তা অধিকার সংস্থা কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)ও সরকারের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, “বিদেশি বা বেসরকারি অর্থায়নের পথে গেলে ব্যয় বাড়ে, দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। সরকার এখন নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে—এটি সঠিক পদক্ষেপ।” তিনি আরও বলেন, “প্রকল্প দ্রুত ও প্রতিযোগিতামূলকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ঠিকাদার নিয়োগ, দরপত্র ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আগের বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাদের কর্মকাণ্ডকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে বিচারের আওতায় আনা দরকার।”
জ্বালানি নিরাপত্তা ও সাশ্রয় বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ:
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) বাংলাদেশের একমাত্র তেল শোধনাগার এবং এটি বিপিসির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়। ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) সম্পন্ন হলে দেশের অপরিশোধিত তেল আমদানি কমবে এবং বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে রিফাইনারির বার্ষিক পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। এতে আমদানিনির্ভরতা কমবে এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা জোরদার হবে। এছাড়া, ইআরএল-২ প্রকল্পটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পের ফরওয়ার্ড লিংকেজ হিসেবেও কাজ করবে।
প্রকল্পের মাধ্যমে ইউরো-৫ স্ট্যান্ডার্ড জ্বালানি উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতে নির্গমন কমবে, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বাড়বে এবং জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের পর পরিবহন খরচ কমবে, পণ্যের দাম হ্রাস পাবে এবং জ্বালানি আরও সাশ্রয়ী হবে।

