চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের প্রধান দ্বার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ বন্দর দিয়ে প্রায় ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ২০ ফুট ইকুইভ্যালেন্ট কনটেইনার (টিইইউ) হ্যান্ডলিং হয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহার করে পরিবহন হয়েছে।
মহাসড়কটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সড়কপথগুলোর একটি। এটি ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামকে যুক্ত করেছে এবং দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বড় অংশ বহন করে। তবুও সড়কের সক্ষমতা প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ানো হয়নি। যানজট, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে পণ্য পরিবহন সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। সমস্যার সমাধান করতে সড়ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের পাশাপাশি রেল ও নৌপথকে কার্যকরভাবে গড়ে তোলা জরুরি।
২০১৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়। অনেকেই ভেবেছিলেন এ সমস্যা দূর হয়েছে। বাস্তবে তা হয়নি। যানবাহনের চাপ সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি। বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ, ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নেই। মহাসড়কের পাশে অসংখ্য হাটবাজার ও বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে। দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে নিয়মিত যানজট, সময় অপচয় এবং পণ্য পরিবহনের অতিরিক্ত ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চাহিদা ও সুফল বিবেচনা করা হয়। বিশ্বব্যাপী এটাই প্রচলিত চর্চা। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক প্রকল্পে পরিকল্পনাহীনতা স্পষ্ট। নকশায় ভুল থাকছে, বাস্তবায়নের পরে নির্মাণ ত্রুটি ধরা পড়ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন মহাসড়কের ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা দেখা দিয়েছে।
মহাসড়ক নির্মাণে ট্রাফিক গ্রোথ বিবেচনা করা অত্যাবশ্যক। সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী ট্রাফিক গ্রোথ কমপক্ষে ১০ শতাংশ ধরে ডিজাইন করতে হবে। কিন্তু চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণের সময় এটি মাত্র ৮ শতাংশ ধরা হয়েছিল। চালুর পর যানবাহনের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি হওয়ায় সড়ক ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর। উন্নত দেশসহ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা সহজে কাজে লাগানো সম্ভব ছিল। কিন্তু তা অনুসরণ না হওয়ায় মহাসড়কের কার্যকারিতা শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজটের কারণে পণ্য পরিবহনের খরচ ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিল্প, বাণিজ্য ও ভোক্তা পর্যায়ে। রফতানিকারকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন, আমদানিকারকদের খরচ বাড়ছে। শেষ পর্যন্ত এর বোঝা পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর।
২০২৩ সালে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রসারণের জন্য সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় মহাসড়ক ছয় বা আট লেনে উন্নীত করার বিষয়টি উঠে আসে। প্রাক্কলন করা হয়, এ কাজে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। কিন্তু সমীক্ষার পর প্রকল্প অনুমোদন হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও মেয়াদের শেষ প্রান্তে বড় বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। ফলে মহাসড়ক সম্প্রসারণে কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট। এটি দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেল ও নৌপথের কার্যকর ব্যবহার এবং বিকল্প কনটেইনার রুট না গড়ে তোলা গেলে মহাসড়কের চাপ কমানো কঠিন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা কনটেইনারের ৯৬ শতাংশই সড়ক ব্যবহার করে পরিবাহিত হচ্ছে। রেলপথের ভাগ মাত্র ৩ শতাংশ, নদীপথের ১ শতাংশ। এতে সড়কনির্ভর নীতির ব্যর্থতা স্পষ্ট। রেল ও নদীপথ তুলনামূলকভাবে সস্তা, পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই। কিন্তু রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধার কারণে সড়ককে অতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অন্য পথগুলোকে অবহেলা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) যৌথ উদ্যোগে ঢাকার কেরানীগঞ্জে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে আসা কনটেইনার নদীপথে পরিবহন করে মহাসড়কের চাপ কমানো, আমদানি-রফতানি খরচ ও সময় সাশ্রয় করা এবং পরিবেশবান্ধব পরিবহন প্রচলিত করা। তবে ব্যবসায়ীরা পরিবেশবান্ধব নদীপথে কনটেইনার পরিবহনে আগ্রহী নয়। ফলে কেরানীগঞ্জের টার্মিনালের সক্ষমতার বড় অংশ এখনো অব্যবহৃত। মহাসড়কে চাপ কমানো সম্ভব হয়নি, এবং প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি।
রেলপথ দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনে ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সাশ্রয়ী ও নিরাপদ মাধ্যম। বড় আকারের আমদানি-রফতানিমুখী পণ্য, জ্বালানি, নির্মাণের কাঁচামাল এবং খাদ্যশস্য পরিবহনে রেলওয়ে অন্যতম প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে ইঞ্জিন সংকট ও যাত্রীসেবাকে অগ্রাধিকার দেয়ায় কয়েক বছর ধরে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পরিবহন সেবা দিতে পারছে না। ফলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বিকল্প পথ খুঁজছে। রেলপথে সবচেয়ে বেশি পরিবহন হয় জ্বালানি ও আমদানি-রফতানির কনটেইনার। কিন্তু দিনের পর দিন ইঞ্জিন স্বল্পতার কারণে রেলওয়ে সার্ভিস পরিচালনা ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে বন্দর এলাকায় পণ্য আটকে, প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পণ্যবাহী ট্রেন সার্ভিসের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প ব্যবস্থার দিকে নজর দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রসারণের পাশাপাশি সড়ক, রেল ও নৌপথকে সমন্বিত করে একটি বহুমুখী পরিবহন কৌশল বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। মহাসড়কের বিকল্প হিসেবে পানগাঁও নৌরুট ও রেলপথকে গুরুত্ব দিলে পণ্যের চাপ কমানো সম্ভব হবে। রেলওয়ে ও নৌপথকে নীতিগত সহায়তা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজে লাগালে দেশের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা আরও সাশ্রয়ী, নিরাপদ এবং টেকসই হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি, সমন্বিত সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। নয়তো রেল ও নদীপথে ব্যর্থতা এবং সড়কচাপ বৃদ্ধি চলতে থাকবে, যা ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

