বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। অনুমোদন পেয়েছে বৈশ্বিক তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ লিমিটেড, যারা ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে কারখানা গড়ে তুলছে।
এই নিকোটিন পাউচ দেখতে ছোট টি-ব্যাগের মতো—ভেতরে নিকোটিন, সুগন্ধি ও অন্যান্য রাসায়নিক মিশ্রণ। মুখে রেখে সেবন করা যায় এটি, যা প্রচলিত সিগারেট বা ভেপের বিকল্প হিসেবে বাজারজাত হয়।
কিন্তু এই অনুমোদনের খবর প্রকাশের পরই ক্ষোভে ফেটে পড়েছে দেশের তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। তাদের দাবি, সরকারের এই সিদ্ধান্ত জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই এই অনুমোদন আসে। অথচ সরকার বহুবার ঘোষণা দিয়েছে—২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা হবে। পাশাপাশি, ই-সিগারেট ও ভেপের মতো ইলেকট্রনিক তামাকজাত পণ্যের আমদানি ও বিক্রিও দেশে নিষিদ্ধ।
তামাকবিরোধী কর্মীদের প্রশ্ন—এই অবস্থায় একটি আন্তর্জাতিক তামাক কোম্পানিকে নতুন নিকোটিন পণ্য তৈরির অনুমতি দেওয়া কীভাবে নীতিগতভাবে সঙ্গত হতে পারে?
বেজার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশে নিকোটিন পাউচ উৎপাদন বা রপ্তানির ওপর সুনির্দিষ্ট কোনো আইনগত নিষেধাজ্ঞা নেই। বরং সংস্থাটি পণ্যটিকে “অ্যান্টি-নিকোটিন” বা ধূমপানবিরোধী পণ্য হিসেবে বিবেচনা করছে।
সরকারি নথি অনুসারে, ফিলিপ মরিস বাংলাদেশ প্রায় ৫৮ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগে কারখানাটি নির্মাণ করছে। বছরে ৫৩৬ কোটি ইউনিট পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, এবং এক বছরের মধ্যেই উৎপাদন শুরু করতে হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো এ সিদ্ধান্তকে “বিপজ্জনক” বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, নিকোটিন পাউচ মূলত তরুণদের মধ্যে নতুন করে আসক্তি তৈরির কৌশল।
অধ্যাপক অরূপ রতন চৌধুরী, জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের সদস্য, বলেন—
“নিকোটিন আসক্তিকর পদার্থ। তরুণরা ভেবে নেয় এটি ক্ষতিকর নয়, কিন্তু আসলে এখান থেকেই শুরু হয় ধূমপানের অভ্যাস। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ভয়াবহ—মুখগহ্বরের প্রদাহ, আলসার, এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত।”
একই সুরে বাংলাদেশের অ্যান্টি-টোব্যাকো অ্যালায়েন্সের বিবৃতিতে বলা হয়েছে,
“এটি তামাক কোম্পানিগুলোর নতুন ব্যবসায়িক কৌশল। ধূমপানবিরোধী বার্তা দিয়ে তারা আসলে তরুণ প্রজন্মকে নিকোটিনের ফাঁদে ফেলছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) নিকোটিন পাউচকে তামাকজাত পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংস্থার মতে, এটি প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় কিছুটা কম ক্ষতিকর হতে পারে, কিন্তু পুরোপুরি নিরাপদ নয়।
অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) নিকোটিন পাউচকে নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি (NRT) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।
সিডিসি (CDC)-এর তথ্য অনুযায়ী, নিকোটিন মস্তিষ্কে দ্রুত আসক্তি তৈরি করে—বিশেষত তরুণ ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক।
জাতীয় যুব পরিষদের চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ সাকিব মনে করেন—
“এই সিদ্ধান্ত তরুণদের জন্য ভয়ংকর বার্তা বহন করে। এটি প্রমাণ করছে, এখনো জনস্বাস্থ্যের চেয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।”
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির ২০১৯ সালের গবেষণা অনুযায়ী, শুধু ২০১৭–১৮ অর্থবছরেই তামাক-সংক্রান্ত রোগ ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দেশের ক্ষতি হয়েছিল ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ একই সময়ে সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ২২ হাজার কোটি টাকার সামান্য কিছু বেশি।
পাবলিক হেলথ ল’ ইয়ার্স নেটওয়ার্কের সদস্যসচিব ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ বলেছেন, এই অনুমোদন ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের পরিপন্থী।
তার ভাষায়—“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিকোটিন পাউচকে চিকিৎসা-সহায়ক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ বেজা সেটিকে ‘অ্যান্টি-নিকোটিন’ হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। এটি আদালতের নির্দেশ ও সংবিধান উভয়েরই লঙ্ঘন।”
প্রতি বছর বাংলাদেশে তামাক-সংক্রান্ত রোগে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার মানুষ মারা যায়। এমন বাস্তবতায় ফিলিপ মরিসের মতো তামাক জায়ান্টের নিকোটিন পাউচ উৎপাদনের অনুমোদন প্রশ্ন তোলে—সরকার আসলে কোন পথে হাঁটছে? জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা, না কি বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থরক্ষার পথে?

