বাংলাদেশ শ্রম আইনে বড় ধরনের পরিবর্তনের সময় এসেছে। সরকারের সঙ্গে নিয়োগকর্তা ও মালিকপক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সংশোধনী দেশের আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ এবং জীবনযাত্রার ধরনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানাচ্ছে, এটি শ্রমিকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
অর্থনীতিবিদ ও শ্রম বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত পরিবর্তন ইতিবাচকভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন, এগুলো শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করতে এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক নিরাপত্তা গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ন্যূনতম মজুরি কাঠামোতে পরিবর্তন
নতুন খসড়া, বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫, বর্তমান আইনের ১২৪টি ধারার সংশোধনের প্রস্তাব রেখেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ন্যূনতম মজুরি কাঠামোর পুনর্নির্ধারণ। এখন থেকে প্রতি তিন বছর অন্তর ন্যূনতম মজুরি পুনর্বিবেচনা করা হবে, আগে যেটি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর হতো।
শ্রমিকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বা বৃদ্ধি পূর্বের মতো ৫ শতাংশই থাকবে। এই পরিবর্তন মূলত মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, যাতে শ্রমিকদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে না যায়। অর্থাৎ, শ্রমিকরা তাদের আয় দিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারবে।
বিজিএমইএ সভাপতি হাসান মাহমুদ খান এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের (বিইএফ) সভাপতি ও বিকেএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি বিবেচনায় মজুরি পুনঃনির্ধারণ
প্রস্তাবিত সংশোধন মূলত শ্রমিকদের প্রকৃত আয় রক্ষা ও মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলার লক্ষ্যেই এসেছে। নতুন খসড়ায় বলা হয়েছে, মজুরি পুনর্বিবেচনায় মূল্যস্ফীতি এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে মূল ভিত্তি হিসেবে নেওয়া হবে। অর্থাৎ, শ্রমিকরা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয়ের সঠিক বৃদ্ধি পাবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি শুধু শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নয় বরং শ্রম বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে সাহায্য করবে। মালিকপক্ষও এতে উপকৃত হবে, কারণ মজুরি কাঠামো নিয়মিতভাবে পুনঃনির্ধারণ হলে শ্রমিকদের সন্তুষ্টি বাড়বে এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
বড় কারখানায় বাধ্যতামূলক প্রভিডেন্ট ফান্ড
সংশোধিত খসড়ায় বলা হয়েছে, যে কোনো কারখানায় কমপক্ষে ১০০ জন শ্রমিক থাকলে সেখানে প্রভিডেন্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক হবে। ফান্ডে শ্রমিকের অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক রাখা হলেও বিশেষজ্ঞরা এটিকে শ্রমিকদের দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
প্রভিডেন্ট ফান্ডে অবদানের পরিমাণ কারখানা পর্যায়ে মালিক ও শ্রমিকদের আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে। আগে বিদ্যমান আইনে বলা হতো, যদি তিন-চতুর্থাংশ শ্রমিক লিখিতভাবে প্রভিডেন্ট ফান্ড চালুর দাবি জানায়, তখন মালিক ফান্ড গঠন করবেন।
সংশোধিত খসড়ায় মালিকদের জন্য ফান্ড গঠন বাধ্যতামূলক হলেও শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, যারা চান তারা ফান্ডে অংশ নিতে পারবেন, যারা চান না তারা নিজে অংশগ্রহণ না করলেও হবে।
শ্রমিক ও মালিকপক্ষের জন্য প্রভাব
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই সংশোধন দুই পক্ষের জন্যই উপকারী। শ্রমিকরা নিয়মিত মজুরি বৃদ্ধি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের মাধ্যমে আর্থিক নিরাপত্তা এবং মর্যাদাপূর্ণ কাজের পরিবেশ পাবেন। মালিকপক্ষও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল শ্রম বাজার পাবে।
এছাড়া, প্রতি তিন বছর অন্তর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান অটুট থাকবে। মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনা করা হলে শ্রমিকদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমবে না।
প্রভিডেন্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক হলেও শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ঐচ্ছিক রাখায় এটি স্বচ্ছ ও নমনীয় ব্যবস্থা হবে।
শ্রম আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ দেশের শ্রম বাজারকে আরও স্বচ্ছ, ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক করতে সহায়ক হবে। এটি শুধু আইনগত পরিবর্তন নয় বরং শ্রমিকদের অধিকার ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও শ্রম বিশেষজ্ঞরা শ্রমিকদের মজুরি তিন বছর অন্তর পুনর্নির্ধারণের পদক্ষেপকে যৌক্তিক হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, এটি শুধু শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান রক্ষা করবে না বরং অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মজুরি কাঠামোর স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের পরপরই মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ে। শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমতে থাকে। তাই ইনফ্লেশন একাউন্টিং ও দেশের জিডিপি বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিন বছর অন্তর মজুরি পুনর্নির্ধারণ করা যৌক্তিক।” তিনি আরও যোগ করেন, এটি শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও সাহায্য করবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনও একই মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “পাঁচ বছর খুব দীর্ঘ সময়। এমনকি কম মূল্যস্ফীতির সময়ও পাঁচ বছরে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। তিন বছরে মজুরি পুনর্নির্ধারণ করলে শ্রমিকরা নিয়মিতভাবে তাদের জীবনযাত্রার খরচ সামলাতে পারবেন।”
ড. ফাহমিদা প্রভিডেন্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপকেও যৌক্তিক মনে করেন। তিনি বলেন, “প্রভিডেন্ট ফান্ড ছাড়া একজন শ্রমিক দীর্ঘদিন চাকরি শেষে যখন অবসর নেন, তখন তার কোনো আর্থিক নিরাপত্তা থাকে না। এটি তার অবলম্বনকে শূন্য করে। প্রভিডেন্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করলে শ্রমিকরা চাকরি জীবনের শেষে আর্থিক সুরক্ষা পাবেন।”
তিনি আরও বিশ্লেষণ করে বলেন, “যদি শ্রমিকদের মজুরি তিন বছরে একবার পুনর্নির্ধারণ করা হয়, তবে তারা এক কারখানা ছেড়ে অন্য কারখানায় যাওয়ার প্রবণতা কমবে। ফলে শিল্পখাতে শ্রমিকদের স্থিতিশীলতা বাড়বে, যা উৎপাদনশীলতাকে আরও শক্তিশালী করবে।”
৯০ শতাংশ শ্রমিক এখনও আইনি সুরক্ষার বাইরে
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর নির্বাহী পরিচালক ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ টিবিএসকে বলেন, “আমরা তিন বছর অন্তর ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের সুপারিশ করেছি। এটি শ্রমিকদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য অপরিহার্য। ন্যূনতম মজুরি যেন তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়, সেটি আমাদের প্রধান লক্ষ্য।”
সুলতান উদ্দিন বলেন, “আমরা প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সকল শ্রমিকের জন্য ন্যূনতম জাতীয় মজুরি নির্ধারণের সুপারিশ করেছি। কিন্তু সরকার কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য আইন প্রণয়ন করছে। এর ফলে দেশের ৯০ শতাংশ শ্রমিক, যারা অপ্রাতিষ্ঠানিকখাতে নিয়োজিত, তারা আইনি সুরক্ষার বাইরে থাকবেন।”
তিনি আরও বলেন, “অনেক ছোট ছোট কারখানা আছে যেখানে শ্রমিকের সংখ্যা ৪০-৫০। সেখানে অন্তত ১০ জন শ্রমিক নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা এবং নিয়মিত সিবিএ নির্বাচন নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারকে অবশ্যই এই প্রক্রিয়াটি তদারকি করতে হবে। এটি শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সংগঠনের জন্য অপরিহার্য।”
বাংলাদেশ শ্রম অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়ায় বর্তমান আইনের ১২৪টি ধারা সংশোধন বা নতুন ধারা সংযোজন করা হচ্ছে। গঠিত ত্রি-পক্ষীয় কমিটি, যা সরকারের, মালিক ও শ্রমিক পক্ষ নিয়ে গঠিত, ১২৪টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ১২২টিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এতে শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের সময়কাল এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকরা শুধু তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে না বরং দীর্ঘমেয়াদে শিল্পখাতের উৎপাদনশীলতা ও স্থিতিশীলতা বাড়বে। তিন বছরের মজুরি পুনর্নির্ধারণ শ্রমিক ও অর্থনীতির জন্য ভালো পরিস্থিতি তৈরি করবে।
ট্রেড ইউনিয়ন ও সিবিএ নির্বাচন: মালিকপক্ষের জোরালো অবস্থান ও শ্রমিক সুবিধার সংশোধনী
বাংলাদেশে শ্রম আইন সংশোধনের প্রক্রিয়ায় মালিকপক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে দুটি মূল বিষয়ে এখনো মতপার্থক্য বিদ্যমান। এই বিষয়গুলো হলো—
১. ২০ জন শ্রমিক চাইলেই রেজিস্ট্রার্ড ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারবে কি না।
২. কালেক্টিভ বার্গেইনিং ক্যান্ডিডেট (সিবিএ) নির্বাচনে মোট কাস্টিং ভোটের ৫০%+১ ভোট পেলে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে কি না।
এই দুটি বিষয়ে মালিকপক্ষ এখনও কোনো চূড়ান্ত সম্মতি দেননি। ব্যবসায়ী নেতারা সরকারের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের আমীর ড. শফিকুর রহমানের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছেন।
বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ হাসান খান জানান, মোট ১২৪টি সংশোধনী প্রস্তাবের মধ্যে ১২২টি বিষয়ে মালিকপক্ষ রাজী হয়ে গেছে। “২০ জন শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং সিবিএ নির্বাচনের প্রক্রিয়া—এই দুটি বিষয়ে আমরা এখনও রাজি হইনি। এ দুটি বিষয় চূড়ান্ত হলে সরকার সংশোধন অধ্যাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ করবে।”
ট্রেড ইউনিয়ন ও সিবিএ নির্বাচন নিয়ে বিশ্লেষণ
বিদ্যমান শ্রম আইনের অধীনে, কোনো কারখানায় যদি একটি ট্রেড ইউনিয়ন থাকে, সেটিই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিবিএ হিসেবে গণ্য হয়। নতুন সংশোধিত অধ্যাদেশে বলা হচ্ছে, একটি কারখানায় সর্বোচ্চ ৫টি ট্রেড ইউনিয়ন রাখা যাবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট প্রাপ্ত ট্রেড ইউনিয়নই সিবিএ হিসেবে বিবেচিত হবে।
মালিকপক্ষের প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০ জন শ্রমিকের পরিবর্তে এক ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের জন্য মোট শ্রমিকের ১৫% অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, প্রাথমিকভাবে খুব কম সংখ্যক শ্রমিকের অনুমতি নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা সম্ভব হবে না। মালিকপক্ষের যুক্তি, এতে শ্রমিক ও প্রতিষ্ঠান উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মালিকপক্ষ ২০ জনের অংশগ্রহণে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিরোধী হলেও, অতীতে আমরা দেখেছি শ্রমিকদের ক্ষতি হয়েছে। তাই সিবিএ নির্বাচনে কাস্টিং ভোটের ভিত্তিতে গণনা করা যৌক্তিক।” অর্থাৎ, শুধু মোট শ্রমিকের হিসাব নয়, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের ভোটকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এটি নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও বৈধতা নিশ্চিত করবে।
শ্রমিকদের সুবিধা বৃদ্ধিতে ঐকমত্য
শ্রম আইন সংশোধনের অন্যান্য ধারায় মালিকপক্ষ ও সরকার ইতিমধ্যে একমত পোষণ করেছে। এতে শ্রমিকদের সুবিধা বৃদ্ধি, এবং মালিকের অপরাধে শাস্তির পরিমাণ বৃদ্ধি অন্তর্ভুক্ত। সংশোধন প্রস্তাবের খসড়া তৈরিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO), যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন খাতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। পাইলট, প্রকৌশলী ও কেবিন ক্রুদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকারকে নতুন খসড়ায় সীমিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ, বিদ্যমান আইনে যাদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার ছিল, সেই ধারা সংশোধন করা হচ্ছে।
বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন শুরুর সময় ধর্মঘট বা লকআউটের বিধানও পরিবর্তন করা হয়েছে। পূর্বে প্রথম তিন বছর ধর্মঘট বা লকআউট নিষিদ্ধ ছিল, নতুন খসড়ায় এটি দুই বছরে কমানো হয়েছে। এতে উৎপাদন শুরুর প্রাথমিক সময় ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে সুরক্ষিত রাখার প্রস্তাবনা রয়েছে।
সম্ভাব্য প্রভাব ও বিশ্লেষণ
- মালিকপক্ষের জোরালো অবস্থান শ্রমিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা আনতে পারে।
- ২০ জন শ্রমিক দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অনুমতি না দিলে, ছোট প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট বিভাগে শ্রমিক সংগঠন তৈরি কঠিন হতে পারে।
- কাস্টিং ভোটের ভিত্তিতে সিবিএ নির্বাচন হলে, নির্বাচনী স্বচ্ছতা বাড়বে, তবে মালিকপক্ষের প্রভাবও তুলনামূলকভাবে বেড়ে যেতে পারে।
- শ্রমিকদের সুবিধা ও মালিকের শাস্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মান আনয়ন করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
মোটমাট, শ্রম আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় মালিকপক্ষ ও শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে এখনও দুইটি মূল দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে, তবে শ্রমিক সুবিধা বাড়ানো এবং আইনের আন্তর্জাতিক মান অঙ্কিত করা হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশের পরই চূড়ান্ত রূপ নেওয়া হবে।
কোনো শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা যাবে না
গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনগুলোর অভিযোগ, কিছু কারখানা শ্রমিক চাকরি ছাড়লে তাদেরকে সেন্ট্রাল ডাটাবেসে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখে। এর ফলে ওই শ্রমিক অন্য কারখানায় চাকরি পেতে পারেন না।
নতুন শ্রম আইন সংশোধনীর খসড়ায় বলা হয়েছে, এনআইডি, জন্মসনদ বা বায়োমেট্রিক তথ্য যাচাই করে কোনো নিয়োগকর্তা এমন ডাটাবেস বা তালিকা তৈরি করতে পারবে না, যা ভবিষ্যতে চাকরি নেওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা কখনো কোনো শ্রমিককে ব্ল্যাকলিস্ট করে না। শ্রমিকের চাকরির অবস্থা শ্রম আইন মেনে সার্ভিস বুকে লেখা হয়।
বিকেএমইএ’র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান বলেন, কারখানায় কোনো শ্রমিকের বিরুদ্ধে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, চুরি বা অন্য কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা সার্ভিস বুকে লেখা হয় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
নতুন ধারায় জোরপূর্বক ওভারটাইম, ঋণ আদায়সহ সব বাধ্যতামূলক বা জবরদস্তিমূলক শ্রমও নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।
ছুটি সুবিধা বাড়ছে
শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের ছুটির সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
বর্তমান আইনে প্রতি পঞ্জিকা বছরে শ্রমিকদের ১১ দিনের মজুরিসহ উৎসব ছুটি দেওয়ার বিধান আছে। নতুন আইনে উৎসব ছুটি ১৩ দিন করার প্রস্তাব আছে।
প্রসূতি পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে ৮ সপ্তাহ করে মোট ১৬ সপ্তাহ ছুটি দেওয়া হয়। নতুন প্রস্তাবে এটিকে ৬০ দিন করে মোট ১২০ দিনে উন্নীত করা হচ্ছে। ত্রি-পক্ষীয় কমিটি ইতিমধ্যেই এ অনুমোদন দিয়েছে।
চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরিসহ বাৎসরিক ছুটি প্রতি ২২ দিনে একদিন থেকে কমিয়ে ১৮ দিনে একদিন করা হচ্ছে। কারখানা শ্রমিকদের মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি প্রতি ১৫ দিনে একদিনের পরিবর্তে ১৪ দিনে একদিন করা হবে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী বিদেশি কোম্পানির সমান সুবিধা চায় বিদেশি মালিকরা
বাংলাদেশে শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে মুনাফার ৫ শতাংশ জমা দেওয়ার বিধান পরিবর্তন করে, রপ্তানিমুখী কারখানার মতো সুবিধা চাইছে।
মঙ্গলবার মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়েছে। এতে শ্রম ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় জানা গেছে, রপ্তানিমুখী কারখানাগুলো মুনাফার ৫ শতাংশ জমা না দিয়ে, রপ্তানি আয়ের ০.০৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দেয়। ব্যাংক রপ্তানি মূল্য প্রত্যাবাসনের সময় এটি কর্তন করে সরকারের তহবিলে পাঠায়।
এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুবিধার বিষয়টি শ্রম মন্ত্রণালয় পর্যবেক্ষণ করছে।

