জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করতে ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে চার দফা সংশোধনী এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ট্রাইব্যুনাল গত বছর ১৭ অক্টোবর বিচারকাজ পুনরায় শুরু করার পর থেকে এক বছরের মধ্যে এসব সংশোধনী করা হয়। সরকারের ভাষ্য, সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আইনকে হালনাগাদ করতেই এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রথম সংশোধনী আসে ২৪ নভেম্বর। এর আগে ট্রাইব্যুনাল কেবল দেশের ভেতরে সংঘটিত অপরাধই বিচার করতে পারত। সংশোধনের পর বিদেশে সংঘটিত অপরাধও এ আইনের আওতায় আনা হয়। একই সঙ্গে যুক্ত হয় আরও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
নতুন বিধান অনুযায়ী, যে কোনো দেশের নাগরিক বাংলাদেশের ভেতরে এই আইনে উল্লেখিত অপরাধ করলে তার বিচার করা যাবে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার বা গোয়েন্দা সংস্থাসহ যে কোনো বাহিনীর সদস্যদের বিচারের সুযোগ রাখা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আক্রমণ, নিপীড়ন, গুম, যৌনদাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ ও বন্ধ্যকরণ।
তদন্ত কর্মকর্তাকে তল্লাশি ও নথিপত্র জব্দের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। আসামিপক্ষ এখন ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বিচার চলাকালীন সময়ে অতিরিক্ত সাক্ষী হাজির বা নথি উপস্থাপন করতে পারবে। ট্রাইব্যুনাল অডিও–ভিডিও রেকর্ড ও প্রদর্শন করতে পারবে, এমনকি চাইলে ভার্চুয়াল শুনানির ব্যবস্থাও করতে পারবে। ভুক্তভোগী বা সাক্ষীর শারীরিক উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। বিদেশি আইনজীবীদের অংশগ্রহণের সুযোগও দেওয়া হয়, যা আগে ছিল না।
দ্বিতীয় সংশোধনী আসে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি। ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ নামের এই পরিবর্তনে আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের সময়সীমা ছয় সপ্তাহ থেকে কমিয়ে তিন সপ্তাহ করা হয়, যাতে বিচার দ্রুত সম্পন্ন হয়। এ ছাড়াও ট্রাইব্যুনালকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এখন অভিযুক্তের সম্পদ জব্দ, বিদেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও তল্লাশির অনুমতি ছাড়াই তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।
তৃতীয় দফায়, চলতি বছরের ১০ মে, আইন সংশোধন করে রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী সংগঠন বা ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয়। এর আগে এমন সুযোগ ছিল না। সবশেষ ও সবচেয়ে আলোচিত সংশোধনী আসে ৬ অক্টোবর। উপদেষ্টা পরিষদ ৪ সেপ্টেম্বর অনুমোদনের পর রাতে সরকার অধ্যাদেশ জারি করে। এর মাধ্যমে ১৯৭৩ সালের আইনে নতুন ধারা ২০(সি) যুক্ত হয়।
এই ধারায় বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন হলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য হবেন। তিনি জনপ্রতিনিধি থাকলে সেই পদও হারাবেন। ফলে গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ হারান।
গেজেটে উল্লেখ করা হয়, যাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে তারা সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, চেয়ারম্যান, মেয়র বা প্রশাসক হিসেবে প্রার্থী হতে বা দায়িত্ব নিতে পারবেন না। এমনকি সরকারি কোনো সেবায় বা অফিসে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতাও হারাবেন। তবে ট্রাইব্যুনাল কাউকে খালাস দিলে এসব বিধান প্রযোজ্য হবে না।
৬ অক্টোবর প্রকাশিত গেজেটে সংশোধনীগুলোর ‘ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা’ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আইন কার্যকর হওয়ার আগের ঘটনাও এর আওতায় আসবে। সাধারণত কোনো আইন পাস হওয়ার পরের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তবে এই আইন তার ব্যতিক্রম।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল। সে বিচার ১৪ বছর চলার পর গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পর একই ট্রাইব্যুনাল ব্যবহার করে নতুন করে বিচার শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার।
গত বছর ১৪ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “জুলাই গণহত্যার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই হবে।” তিনি জানান, ১৯৭৩ সালের আইনটি ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়েছিল, এবার জুলাই গণহত্যায় দায়ীদের বিচারের জন্য একই আইন আরও হালনাগাদ করা হয়েছে।

