নিবন্ধন অধিদপ্তরের ইতিহাসে বড় সুখবর। অবশেষে প্রথমবারের মত নিজস্ব নিয়োগবিধি পেলেন রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এই বিষয়ে আজ সোমবার (২০ অক্টোবর) নিবন্ধন অধিদপ্তরের (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা-২০২৫ নামে গেজেট প্রকাশ করেছে আইন মন্ত্রণালয়।
আর এর মধ্যমে দেশ স্বাধীনের ৫৪ বছরসহ রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টের দীর্ঘ ইতিহাসে বড় একটি সাফল্যের পালক যুক্ত হতে যাচ্ছে, যা বছরের পর বছর প্রত্যাশা করে আসছিলেন এই অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মাধ্যমে নিরসন হবে নানা জটিলতার।
সাব-রেজিস্ট্রাররা পদোন্নতি পাবেন একেবারে শীর্ষপদ আইজিআর পর্যন্ত। যা বছরের পর বছর প্রত্যাশা করে আসছিলেন এই অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রজ্ঞাপন বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৫৭ নং আইন) এর ধারা ৫৯ এর উপ-ধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সংবিধানের ১৪০(২) অনুচ্ছেদের বিধান মোতাবেক, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে, নিম্নরূপ বিধিমালা প্রণয়ন করল। তা হলো-
১। শিরোনাম- এ বিধিমালা নিবন্ধন অধিদপ্তর (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা, ২০২৫ নামে অভিহিত হইবে।
২। সংজ্ঞা- বিষয় বা প্রসঙ্গের পরিপন্থি কোনো কিছু না থাকিলে, এ বিধিমালায়-
(ক) ‘কমিশন’ অর্থ বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশন।
(খ) ‘জিপিএ’ অর্থ Grade Point Average (GPA)।
(গ) ‘তফশিল’ অর্থ এই বিধিমালার কোনো তফশিল।
(ঘ) ‘নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ’ অর্থ সরকার বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা।
(ঙ) ‘পদ’ অর্থ তফশিলে উল্লিখিত কোনো পদ।
(চ) ‘প্রয়োজনীয় যোগ্যতা’ অর্থ সংশ্লিষ্ট পদের জন্য তফশিলে উল্লিখিত যোগ্যতা।
(ছ) ‘শিক্ষানবিশ’ অর্থ কোনো পদে শিক্ষানবিশ হিসাবে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি।
(জ) ‘সিজিপিএ’ অর্থ Cumulative Grade Point Average (CGPA); এবং
(ঝ) ‘স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়’ বা ‘স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান’ বা ‘স্বীকৃত বোর্ড’ অর্থ আপাতত বলবৎ কোনো আইন দ্বারা বা আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান বা বোর্ড এবং এই বিধিমালার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কমিশনের সঙ্গে পরামর্শক্রমে, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বলিয়া ঘোষিত অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান বা বোর্ড।
এদিকে এই বিধিমালা জারির ফলে সাবরেজিস্ট্রারদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি ছাড়াও পদোন্নতির নতুন দ্বার উন্মোচিত হলো। নিবন্ধন অধিদপ্তরের শীর্ষ পদ (আইজিআর) পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের সুযোগ নিশ্চিত হলো। নতুন করে অ্যাডিশনাল আইজিআর এবং ডিআইজিআর পদও সৃষ্টি হচ্ছে। আইআরও/এআইজিআর পদ বেড়ে ১৭টি হয়েছে। এছাড়া বিধিমালার মধ্যে প্রতিটি পদের সরাসরি নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।
বিধিমালা প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রাররা জানান, ব্রিটিশ আমলে ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রদানের দালিলিক প্রথা চালু হয়। মূলতঃ তখন থেকে একধরনের রেজিস্ট্রেশন প্রথা শুরু হয়। এরপর ১৯০৮ সালে এসে রেজিস্ট্রেশন আইন প্রবর্তন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে দ্য গেজেটেড অফিসার্স (রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট) রিক্রুটমেন্ট রুলস প্রণয়ন করা হয়, যা সংশোধন করা হয় ১৯৯৬ সালে। এভাবে চলে আসছিল। কিন্তু এ বিভাগের জন্য নিজস্ব নিয়োগবিধি প্রণয়ন নিয়ে দীর্ঘদিনের দাবি থাকলেও সেটি নানা কারণে বাস্তবায়ন হয়নি।
অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর ২০২১ সালে এসে নিবন্ধন অধিদপ্তরের (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটি ২০২২ সালের ১২ মে উপস্থাপন করা হয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রস্তাবিত বিধিমালা ঘুরতে থাকে চরকির মতো। এভাবে নানা প্রতিবন্ধকতা ও প্রক্রিয়া পার হয়ে ১১ ফেব্রুয়ারি পিএসসির মতামতসহ বিধিমালাটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। অতঃপর শুরু হয় ‘পিলোপাস প্রতিযোগিতা’।রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তারা তদবির করলে এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে গিয়ে ফের আটকে যায়। কিন্তু বিধিমালা আর আলোর মুখ দেখে না।
সূত্র জানায়, বিধিমালাটি এ পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে বেশ কয়েকজন সাবরেজিস্ট্রার বছরের পর বছর নিরলসভাবে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা রেজিস্ট্রার হিসাবে কর্মরত বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিআরএস) সাবেক মহাসচিব শেখ কাওসার আহমেদ এবং মুন্সীগঞ্জ জেলা সাবরেজিস্ট্রার এবং বিআরএস-এর বিদ্যমান কমিটির সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ রমজান খান।
বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এই দুজন ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বর্তমান কমিটির মহাসচিব ও খিলগাঁও সাবরেজিস্ট্রার মাইকেল মহিউদ্দিন আব্দুল্লাহ এবং চাঁদপুর জেলা সাবরেজিস্ট্রার ও বিআরএস-এর সাবেক আইন সম্পাদক আকবর আলী।
এদিকে গেজেট জারি হতে যাওয়া বিধিমালা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরএস-এর সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ রমজান খান গণমাধ্যমকে বলেন, এই বিধিমালা আমাদের সার্ভিসের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল। অবশেষে তা পূরণ হলো। এর পেছনে আমার মতো অনেকে কাজ করেছেন। প্রত্যেকের অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই। এখন আমরা আইন উপদেষ্টাসহ আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ।
তিনি বলেন, বিধিমালাটি কার্যকর হওয়ার পর থেকে পুরো রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টজুড়ে একধরনের স্বস্তি ফিরে আসবে। কারণ, এর ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যেকে উপকৃত হবেন। অনেক স্থানে আমাদের প্রাপ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে এর বিনিময়ে আমরা ইমেজ পুনরুদ্ধারসহ সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি জনগণ যাতে দ্রুত প্রাপ্য সেবা পান, সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবো।
বিআরএস-এর মহাসচিব মাইকেল মহিউদ্দিন আব্দুল্লাহ বলেন, এই বিধিমালার গেজেট জারি হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের সংগঠনের বড় একটি দায় ও দায়িত্ব শেষ হলো। এজন্য এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, এরপর আমাদের আরও কিছু জরুরি দাবিদাওয়া পেন্ডিং রয়েছে। বিশেষ করে জেলা রেজিস্ট্রারদের জন্য গাড়ি প্রাধিকার ও আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বিষয়টি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবেচনাধীন রয়েছে। এরপর আমরা ই-রেজিস্ট্রেশন চালুসহ কীভাবে সেবার মান আরও বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে কিছু পরিকল্পনা সরকারের কাছে তুলে ধরব।