দেশের শ্রমমানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা, মালিক-শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ নীতিগত ও চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গত বৃহস্পতিবার এ অনুমোদন দেওয়া হয়।
নতুন অধ্যাদেশে শ্রমিকের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরও সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভবিষ্য তহবিল বা সর্বজনীন পেনশন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। সংশোধিত আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো আন্তর্জাতিক শ্রমমানের সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমনীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং শ্রমিক-মালিক উভয়ের অধিকার সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।
শ্রম আইন সংশোধনে অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে অনেক দিন ধরেই দাবি ছিল, এমনকি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিবেচনার জন্য বলা হয়েছিল যে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনটা যেন সহজ করা হয়। আমরা শ্রম সংস্কার কমিশন থেকে শ্রমিকের সম্মতি আনুপাতিক হার থেকে সংখ্যায় নিয়ে আসার জন্য স্পষ্ট সুপারিশ করেছিলাম।
কোনো প্রতিষ্ঠানে ২০ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক থাকলে ২০ জনের সম্মতিতে ইউনিয়ন নিবন্ধন করা যাবে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে ১০০ বা তার কম শ্রমিক রয়েছে, তাদের জন্য অসুবিধা হবে। এ ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে ১০ জন বা ১০ শতাংশ করা হলে গ্রহণযোগ্য হয়। না হলে ছোট প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করা কঠিন হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যে অগ্রগতির কথা বলছি, সেটি ম্লান হয়ে যাবে। নতুন ব্যবস্থায় আরেকটি চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান বা কারখানার শ্রমিকসংখ্যার যে শ্রেণি বা স্ল্যাব করা হয়েছে, সেটি প্রমাণ করতে গিয়ে যেন আবার নতুন করে জটিলতা শুরু না হয়। সেটি হলে কিন্তু পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না।
শ্রম আইন সংশোধনে আরেকটা বড় অগ্রগতি হয়েছে যে শ্রমিকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মাধ্যমে অনেককে শ্রমিক হিসেবে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। তাতে অস্পষ্টতা দূর হয়েছে। এখন তাদের জন্য বিশেষ করে গৃহশ্রমিক ও ব্যক্তিগত গাড়িচালকদের সংগঠন করার অধিকারটা নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ক্ষেত্রে পেশাভিত্তিক সংগঠন করার একটা বিধান আনতে হবে।
নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস দাবি করেছিলেন শ্রমিকনেতারা। সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি করা হয়েছে ১২০ দিন (চার মাস)। এ ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হয়নি। ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি অনেক ক্ষেত্রেই পাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা। এখানে বৈষম্য নিরসন হওয়া দরকার ছিল।
জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ও সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখছি না। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের স্বীকৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়গুলো লাগবে। না হলে একজন গৃহশ্রমিক বা একজন ব্যক্তিগত গাড়িচালকের মজুরি কিসের ভিত্তিতে ঠিক হবে। তাকে তো কোনো না কোনো সুরক্ষা স্কিমে রাখতে হবে, তা না হলে অবসরের পর সে কোথায় যাবে। সংশোধনীতে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ তহবিল করার কথা বলা হয়েছে। এটি ভালো অগ্রগতি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। সে কারণে দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ তহবিল চেয়ে জাতীয় দুর্ঘটনা তহবিল করা যেতে পারত।
সবশেষে বলতে চাই, সংশোধন যেটি হয়েছে সেটি প্রশংসনীয়। এই অগ্রগতি যাতে সবাই পায়, তার জন্য আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় সংশোধনী আনতে হবে। এ ছাড়া সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এবং শ্রমিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন হলে সুবিচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এই তিনটা জিনিস খুবই জরুরি। এগুলো না থাকলে শ্রম আইন সংশোধনের অগ্রগতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। সেটা আমরা কেউই চাই না।

