একটি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সাক্ষীদের জবানবন্দী গ্রহণের পর অপরপক্ষ বা তাদের আইনজীবী সাক্ষীদের প্রশ্ন করেন। এই প্রশ্ন করার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় জেরা বা ক্রস এক্সামিনেশন। এটি অপরপক্ষের অধিকার, যার মাধ্যমে মামলার প্রকৃত সত্য উদঘাটনের সুযোগ তৈরি হয়।
আইনি ভিত্তি ও উৎস:
জেরার নিয়মাবলি সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ সালের ১৩৭ থেকে ১৬৬ ধারায় নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আইনে বলা হয়েছে, যখন বিরুদ্ধ পক্ষ কোনো সাক্ষীকে প্রশ্ন করে, সেটিই জেরা হিসেবে গণ্য হয়। এই প্রক্রিয়া প্রাচীন রোমান ও গ্রীক আইনি ব্যবস্থার অংশ ছিল, যেখানে সাক্ষ্যের সত্যতা যাচাই করতে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি চালু ছিল। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে এটি “সাধারণ আইন” ব্যবস্থায় গৃহীত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশের বিচারব্যবস্থায় প্রচলিত হয়। বর্তমানে জেরা একটি আনুষ্ঠানিক ও অপরিহার্য আইনি প্রক্রিয়া।
জেরার কার্যপ্রণালী:
দেওয়ানি ও ফৌজদারি—উভয় ধরনের মামলায় সাক্ষী উপস্থিত হয়ে জবানবন্দী দেন। বাদী নিজে সাক্ষ্য দেওয়ার পর বিবাদী পক্ষ তাকে জেরা করে। এরপর বাদীপক্ষের প্রতিটি সাক্ষীর জবানবন্দী শেষ হলে তাদেরও বিবাদী পক্ষ জেরা করে অর্থাৎ এক পক্ষ সাক্ষ্য উপস্থাপন করার পর অপর পক্ষের প্রশ্ন করাকেই জেরা বলা হয়। আদালত চাইলে কোনো সাক্ষীকে সমন জারি করে ডেকে নিতে পারেন, যদি মনে করেন তাঁর সাক্ষ্য মামলার প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ। তখন উভয় পক্ষই তাকে জেরা করতে পারে। এমনকি পুনরায় জবানবন্দী নিলে পুনরায় জেরা করারও বিধান আছে। এই প্রক্রিয়ায় সাক্ষীর বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা হয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়।
জেরার সীমা ও নিয়ম: জেরা কেবল মামলার প্রাসঙ্গিক বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাক্ষীকে কুৎসামূলক, বিরক্তিকর বা অপরাধমূলক প্রশ্ন করা যাবে না। যদি দেখা যায় সাক্ষী মিথ্যা বলছেন বা সত্য গোপন করছেন, তাহলে নিজ পক্ষও তাকে জেরা করতে পারেন—যা সাক্ষ্য আইনের ১৫৪ ধারায় উল্লেখ আছে।
সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা: সাক্ষ্যের কোনো অংশ বিশ্বাসযোগ্য হলে সেটি আদালত বিবেচনায় নিতে পারেন। শুধু অসঙ্গতি থাকলেই পুরো সাক্ষ্য অগ্রহণযোগ্য হয় না। যেমন, ফরিদ জমাদার বনাম রাষ্ট্র মামলায় (6BCR 1986, পৃষ্ঠা 179) আদালত বলেছেন—আংশিক অসঙ্গতি থাকলেও বিশ্বাসযোগ্য অংশ প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে। একইভাবে একাব্বর খান বনাম রাষ্ট্র (29DLR (AD) 221) মামলায়ও এ নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জেরার গুরুত্ব ও উদ্দেশ্য: হাইকোর্ট বিভাগ বলেছে, “Cross Examination of witness is the Greatest Legal Engine for discovery of truth.” [57DLR (HCD) 513] অর্থাৎ সত্য উদঘাটনের সর্বশ্রেষ্ঠ আইনি উপায় হলো জেরা। এটি যেমন প্রতিপক্ষের দুর্বলতা উন্মোচন করে, তেমনি নিজের পক্ষে সত্য প্রতিষ্ঠার সহায়ক। আরও বলা হয়েছে, “জেরার উদ্দেশ্য হল সাক্ষ্যের সত্যতা, নির্ভুলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করা।” [১৮ বিএলডি (এইচসিডি) ১৩৪] দীর্ঘ ও বিভ্রান্তিকর জেরা করা অনুচিত—কারণ এতে সাক্ষীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং তা সত্য অনুসন্ধানে বাধা দেয়।
ন্যায়বিচারে জেরার ভূমিকা: জেরা বিচারপ্রক্রিয়ার এমন এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা বিচারককে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে। নূর মোহাম্মদ বনাম সুলতান আহমদ মামলায় (40DLR 369) আদালত বলেন— “The Rule of Cross Examination is not merely a technical rule of evidence, but a rule of essential justice.” অর্থাৎ জেরা কেবল প্রমাণের কৌশল নয়, এটি ন্যায়বিচারের মৌলিক নিয়ম—যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ পান।
জেরা একটি মামলার সত্য উদঘাটনের অপরিহার্য আইনি প্রক্রিয়া। এটি সাক্ষ্যের নির্ভুলতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করে আদালতকে ন্যায়বিচারে পৌঁছাতে সাহায্য করে। তাই বলা যায়, জেরা শুধু প্রশ্নোত্তরের ধারা নয়, এটি সত্য ও ন্যায়ের পথে অগ্রযাত্রার সর্বশ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। সূত্র: Lawyers Club

