চট্টগ্রামের হালদা নদী দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। নদীটির জীববৈচিত্র্য ও মা মাছের প্রজনন রক্ষায় ৪৬ কোটি টাকার একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে মৎস্য বিভাগ। প্রকল্পে হ্যাচারি আধুনিকায়নের কথা থাকলেও মাঠপর্যায়ে তা বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে মারাত্মক দুর্বলতা। ছয়টি হ্যাচারির মধ্যে সচল রয়েছে মাত্র দুটি বাকি চারটি বছরের পর বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এসব হ্যাচারিতে ব্যবহৃত ডিম ফোটানোর সরঞ্জাম, সিস্টেন ও ট্রাংকগুলোর অবস্থা করুণ। অভিযোগ উঠেছে, কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাব ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি মা মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম ঘনিয়ে এলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
প্রায় দেড় বছর আগে শুরু হওয়া প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ছিল নদীর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ। এই উদ্দেশ্যে একাধিক উদ্যোগের মধ্যে মৌসুমি ডিম সংগ্রহকারীদের জন্য পুরোনো হ্যাচারিগুলোর সংস্কার করে আধুনিক করার পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীর আর কিছু ক্ষেত্রে কাজ শুরুই হয়নি।
হালদা পাড়ের মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে স্থানীয় প্রশাসন ও নৌ পুলিশের সমন্বয়ে পরিচালিত অভিযানে কিছুটা সুফল মিলেছে। হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলায় হাজার হাজার মিটার জাল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যার ফলে নদীতে মা মাছের বিচরণ বেড়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, আগামি অমাবস্যায় যদি অনুকূল ঝড়-বৃষ্টির পরিবেশ তৈরি হয় তবে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে।
নদীর দুই পাড়ে ঘুরে দেখা গেছে, ডিম সংগ্রহকারীরা নৌকা, জাল ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি হ্যাচারিগুলোর সংস্কারকাজে অনীহা ও ধীরগতি দেখা গেছে। মৌসুম শুরু হয়ে যাওয়ার পরও হ্যাচারির অধিকাংশ কাজ শেষ হয়নি ফলে এবারের মৌসুমে তাঁরা সরকারি সুবিধা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকেই তাই পুরনো পদ্ধতিতে মাটির কুয়ায় ডিম রেখে পোনা উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, হ্যাচারিগুলোতে ডিম সংগ্রহকারীদের সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নেই। প্রতিটি কেয়ারটেকারের সঙ্গে একজন করে কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হলেও কার্যকর সহযোগিতার ঘাটতি রয়েছে। রাউজানে মৎস্য বিভাগের তিনটি হ্যাচারির মধ্যে পশ্চিম গহিরা ও কাগতিয়া বহু বছর ধরে পরিত্যক্ত সংস্কারের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। মোবারকখীল হ্যাচারিতে সংস্কারকাজ চললেও এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
হাটহাজারী উপজেলার মাছুয়াঘোনা হ্যাচারিতে তুলনামূলকভাবে উন্নয়নকাজ এগিয়ে চলেছে। এই হ্যাচারিতে কর্মরত কম্পিউটার অপারেটর সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এখানে থাকা ৪০টির মতো সিস্টেনে ডিম ফোটানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাঁরা। শ্রমিকদের সঙ্গে তিনি নিজেও কাজ করছেন।
অপরদিকে মাদার্শা শাহমাদারী হ্যাচারিতে দেখা গেছে, আগের তৈরি সিস্টেন ট্রাংকগুলোর অধিকাংশই ফাঁটল ধরা ও ফুটো হয়ে পড়ে আছে। দুজন মিস্ত্রি ক্ষতিগ্রস্ত ট্রাংক মেরামতের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। রাজমিস্ত্রি সামশুল আলম জানান, পানির সঞ্চালন লাইন থেকে নাটবল্টু চুরি হয়ে গেছে এবং গভীর নলকূপের পাম্পটি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একটি শ্যালো পাম্প দিয়ে নদীর পানি টেনে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই হ্যাচারির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ইয়াকুব আলী জানান, এখানে হ্যাচারি সহকারী আবদুর রহমান ও কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে সাইফুল ইসলাম কাজ করছেন। তবে হ্যাচারির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, সবকিছুই ঠিকঠাক আছে।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে হালদা প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, কিছু জটিলতার মধ্যেও দ্রুত কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হ্যাচারিগুলোর সংস্কারকাজ শেষ করা যাবে।
তবে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা এবং সময়সীমার মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি দেখে সংশ্লিষ্টদের সে আশায় এখনই আস্থা রাখতে পারছে না হালদার ডিম সংগ্রহকারীরা। প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থের সঠিক ব্যবহার এবং হ্যাচারিগুলোর কার্যকর রূপান্তর না হলে প্রাকৃতিক এই সম্পদ সংরক্ষণে সরকারি উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে এমনই আশঙ্কা স্থানীয়দের।