রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে দেশের নানা অঞ্চলে সম্প্রতি যে অস্ত্র-সহিংসতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েছে, তার পেছনে রয়েছে থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে সংঘটিত সহিংসতায় দেশের বিভিন্ন থানায় চালানো হামলায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এখন এসব অস্ত্রই ব্যবহার হচ্ছে হত্যা, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও রাজনৈতিক সহিংসতায়।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে মূল ভূমিকা রাখছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্যতা। এর মধ্যে পুলিশের অস্ত্র চলে যাওয়া কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসীদের হাতে পরিস্থিতিকে করেছে আরো ভয়াবহ।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন দেশের ৬৬৪টি থানার মধ্যে ৪৬০টি এবং ১১৪টি ফাঁড়িতে হামলা ও লুটপাট হয়। ওই হামলায় পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ ১১ প্রকারের মোট ৫ হাজার ৭৫৩টি অস্ত্র লুট করা হয়।
এ ছাড়া ছিনিয়ে নেওয়া হয় ছয় লাখ ৫১ হাজার ৮৩২ রাউন্ড গোলাবারুদ। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে চার হাজার ৩৮৪টি অস্ত্র এবং তিন লাখ ৯৪ হাজার ৮৭ রাউন্ড গুলি। তবে এখনো নিখোঁজ রয়েছে এক হাজার ৩৬৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং দুই লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৫ রাউন্ড গুলি।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, লুট হওয়া অস্ত্রের একটি বড় অংশ এখন সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী চক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কেউ এগুলো নিজের কাছে রাখছে, আবার কেউ বিক্রি করে দিচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে উদ্ধার অভিযান জোরালোভাবে শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে তার গতি কমে আসে। যদিও বর্তমানে যৌথ বাহিনী আবারো অভিযান শুরু করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, “থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি সাধারণ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত কিছু অপরাধের উদাহরণও তুলে ধরেছে পুলিশ। গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে এমনই অস্ত্র দিয়ে গুলাগুলি ও হত্যাকাণ্ড ঘটে।
একই বছরের নভেম্বরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে থেকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শাহিদা ইসলাম নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি ওয়ারীতে মায়ের সঙ্গে বাস করতেন। পরে জানা যায়, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল পুলিশের লুট হওয়া একটি অস্ত্র দিয়ে। এ ঘটনায় শাহিদার প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ বছরের মে মাসেও চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে পারভেজ ও রিয়াজুর রহমান নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি রিভলভার, গুলি ও ধারালো দেশি অস্ত্র। পুলিশ জানায়, এই রিভলভারটি ৫ আগস্ট পাহাড়তলী থানা থেকে লুট করা হয়েছিল। তারা এই অস্ত্র দিয়ে যাত্রীদের ছিনতাই করত।
এরপর গত ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের বারিক বিল্ডিং মোড় এলাকা থেকে আরিফ হোসেন নামের একজনকে অস্ত্র ও গুলিসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরবর্তীতে তার আস্তানা থেকে একটি ইতালির তৈরি পিস্তল ও ৫০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়। ডবলমুরিং থানার ওসি রফিক আহমেদ বলেন, “আরিফ একজন সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের নেতা এবং তার কাছ থেকে উদ্ধার করা অস্ত্র থানার লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যেই পড়ে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, যেসব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, সেগুলো অপরাধ চক্রের হাতে রয়ে গেছে এবং দেশব্যাপী সহিংসতা ও অপরাধে ব্যবহৃত হচ্ছে।