মো. তাজুল ইসলাম টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢোকেন। এরপর টাকা খরচ করে হন সংসদ সদস্য (এমপি)। এমপি হওয়ার পর রাজনীতিই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান ব্যবসা। ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটে’ তিনি আবারও বিজয়ী হন। এর পর আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করে। সেই মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে বড় চমক ছিল তাজুলের মন্ত্রী হওয়া। একজন তুলনামূলক অগুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া ছিল অবিশ্বাস্য। পুরো জাতি তখন বিস্ময়ে স্তব্ধ।
তাজুলের উত্থান ও প্রভাব প্রতিপত্তির পেছনে রয়েছে দুর্নীতির শক্ত ভিত্তি। সীমান্তবর্তী এলাকা কুমিল্লায় চোরাচালানের মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু। পরে সিঅ্যান্ডএফ (ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং) এজেন্ট হয়ে অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলেন। এ সময় রাজনীতিতে যুক্ত হন অবৈধ আয় বৈধ করার আশায়।
দলীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন অর্থ দিয়ে। টাকা দিয়ে দলের কমিটিতে স্থান, পরে আবার টাকা দিয়ে এমপি পদ—সবই ছিল লেনদেনের অংশ। ঘনিষ্ঠদের বলতেন, ‘রাজনীতির মতো লাভজনক ব্যবসা আর নেই।’ ২০১৮ সালে মন্ত্রী হওয়ার জন্য ‘বিনিয়োগ’ করেন ১০০ কোটি টাকা। বিনিময়ে মেলে সরকারের সবচেয়ে বড় বাজেটধারী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ঐতিহ্যগতভাবে দলের সাধারণ সম্পাদক পেতেন। কিন্তু শেখ হাসিনা এ প্রথা ভেঙে নিজের বেয়াই তাজুলকে দেন এই মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পরই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যেন নিলামে উঠেছিল। দায়িত্ব নেওয়ার পর তাজুল নিজেই ঘনিষ্ঠদের বলতেন, ‘আমি টাকা দিয়ে মন্ত্রী হয়েছি, লাভসহ তা তুলতেই হবে।’
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সরাসরি কমিশন দাবি করতেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের কোনো ফাইল গেলেই বলতেন, ‘এই চেয়ারের দাম ১০০ কোটি টাকা। কমিশন না দিলে টাকা উঠবে কীভাবে?’ ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মন্ত্রণালয় কার্যত হয়ে ওঠে লুটপাটের কেন্দ্র। দলের নেতাকর্মীরা তাঁকে ডাকতেন ‘শতকোটি টাকার মন্ত্রী’ নামে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর সম্পদ বেড়েছে ২৪২ গুণ। এক দশক আগে ছিল মাত্র ১৬ কোটি টাকার মতো, যা এখন ১১৮ কোটি ছাড়িয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ বহু গুণ বেশি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, জেলা পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভা—সব জায়গায় বরাদ্দের নামে চলেছে কমিশন বাণিজ্য। এসব কাজে তদারকি করতেন তাজুলের ভাতিজা শাহাদাৎ হোসেন ও এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব) জাহিদ হোসেন। কমিশন আদায়ে আরও জড়িত ছিলেন তাঁর শ্যালক মহব্বত আলী, ভাতিজা আমিরুল ইসলাম ও উন্নয়ন সমন্বয়ক কামাল হোসেন। এদের প্রত্যেকেই এখন শতকোটি টাকার মালিক।
তাজুল ১৯৯৬ সালে প্রথমবার এমপি হন কুমিল্লা-৯ আসন থেকে। এরপর ২০০৮ সাল থেকে টানা চারবার নির্বাচিত হন। প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই জীবনযাত্রায় আসে আমূল পরিবর্তন। তাঁর হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, বছরে আয় দেখিয়েছেন গড়ে চার কোটির বেশি। ২০১৮ সালে সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি টাকার মতো, যা ২০২৪ সালে বেড়ে হয় ১১৮ কোটি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিদেশেও রয়েছে তাঁর বিপুল পরিমাণ সম্পদ।
মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা রাখতেন এপিএস জাহিদ ও ভাতিজা আমিরুল। বদলি, নিয়োগ, টেন্ডার, বরাদ্দ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন এ দুজন। সচিবালয়ে মন্ত্রী না গেলেও তাঁরা ছিলেন নিয়মিত অফিসে। কর্মকর্তারা বলতেন, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে হলে আগে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো। তাঁদের ইচ্ছা ছাড়া মন্ত্রী কিছু করতেন না। এই প্রভাব খাটিয়ে তাঁরা রাতারাতি কোটিপতি বনে যান।
ঢাকার বনশ্রীতে হাউজিং ব্যবসা চালাচ্ছেন জাহিদ। আমিরুল ও জাহিদ ঠিকাদার নিয়োগ, প্রকল্প গ্রহণ, বরাদ্দ, বদলির নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। প্রকৌশলীদের বদলিতে ৩০-৫০ লাখ, প্রকল্প পরিচালকের নিয়োগে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত আদায় করতেন।
পিএস কামাল কুমিল্লার এলজিইডি অফিসের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর মাস্টার এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অধিকাংশ কাজ পেতেন। কমিশন রেখে অন্য ঠিকাদারদের কাছে কাজ বিক্রি করতেন। ২০২৩ সালে দুদক তাঁর বিরুদ্ধে ৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের অভিযোগে মামলা করে। দুদকের অনুসন্ধানে ১৫ কোটি টাকার সম্পদ পাওয়া গেলেও স্থানীয়দের দাবি, কুমিল্লাতেই কামালের সম্পদের পরিমাণ ২০০-৩০০ কোটি টাকা।
ডিপিএইচইর নির্বাহী প্রকৌশলী নাসরুল্লাহও কামালের সহযোগী হিসেবে কোটি কোটি টাকার মালিক হন। মাত্র চার দিনে আড়াই কোটি টাকার কাজ শেষ দেখিয়ে বিল নেন। এভাবেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ছিল ‘লাভের খনি’। আর রাজনীতি ছিল সবচেয়ে লাভজনক বিনিয়োগ—যার প্রতীক হয়ে ওঠেন মো. তাজুল ইসলাম।