ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ চিনিকল বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়েছে। এক কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ ৫৪২ টাকা হলেও বিক্রির দাম মাত্র ১২৫ টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজিতে লোকসান ৪১৭ টাকা। ২০২৪ সালের মাড়াই মৌসুমে মিলের লোকসান হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে এই লোকসান ছিল ৩৪ কোটি টাকা। ব্যাংকে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ মিলটির অর্থনৈতিক অবস্থা জর্জরিত করেছে।
মিল সূত্রে জানা গেছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জীভূত লোকসান, উচ্চ পরিচালন ব্যয় এবং ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চাপ উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে। বাজারে বেসরকারি খাতের চিনি বিক্রির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দরের নির্ধারণ করতে হয়। এর ফলে উৎপাদন ব্যয় ও আয়ের মধ্যে বড় ফারাক তৈরি হচ্ছে।
২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৫৮তম আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধন করা হয়। মিলটির লক্ষ্য ছিল দুই হাজার ৫০০ টন চিনি উৎপাদন, কিন্তু মাত্র এক হাজার ৮৭১ টন উৎপাদন হয়েছে। মোট লোকসানের মধ্যে ৩৪ কোটি টাকা হয়েছে পরিচালন খাতে এবং ৩৬ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণের সুদ বাবদ খরচ হয়েছে। মিলের কারখানা, পরিবহন, মেরামত ও ক্রয়-বিক্রয় খাতের অনিয়ম এবং বেতন-ভাতা ও ওভারটাইম খাতের অনিয়মও উল্লেখযোগ্য লোকসানের কারণ।
মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আ ন ম জোবায়ের জানান, আখচাষিদের আখের মূল্য বৃদ্ধি করতে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনে আবেদন করা হয়েছে। মিলটিকে লোকসানের কবল থেকে রক্ষা ও লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
১৯৬৫ সালে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকায় ২০৮ একর জমির ওপর মিলটি স্থাপিত হয়। ২১ একরে কারখানা, ১০৭ একরে ইক্ষুখামার, ৩৮ একরে কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের আবাসিক কলোনি, ১৮ একরে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র এবং ২৪ একরে পুকুর রয়েছে। ১৯৬৭-৬৮ সাল থেকে মিল উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে মিলটিতে ১,১৮৪ কর্মকর্তাকর্মচারীর পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৬৫৮ জন। দীর্ঘদিন ধরে দক্ষ জনবল ও আখের ঘাটতি মিলটির মূল সমস্যা। প্রতি বছর মিলটি ছয় মাস চালু থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে দুই বা আড়াই মাস উৎপাদন হয়। শ্রমিকদের পুরো বছরের বেতন দিতে হয়।
মিল ব্যবস্থাপনা ও শ্রমিকদের ভাষ্য, ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত মিলটি আধুনিকায়নের সুযোগ পায়নি। পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার হওয়ায় জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় প্রতি বছর বাড়ছে। সরকারের ভ্যাট ও ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার বলেন, এক সময় এ অঞ্চলে অনেক চাষি আখ উৎপাদনে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে খণ্ডকালীন ফসলের দিকে চাষিরা ঝুঁকে পড়ায় কাঁচামাল সংকট দীর্ঘদিন ধরে চলছে।
বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি ও মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি শফিকুর রহমান রিঙ্কু বলেন, ব্রিটিশ আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে মিলটি প্রায়ই বন্ধ হয়ে যায়। মিলটিকে বাঁচাতে সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কৃষকরা জানান, অন্যান্য ফসলের তুলনায় আখের মূল্য কম। মিল বর্তমানে কেজি প্রতি মাত্র ছয় টাকা নির্ধারণ করেছে। এ কারণে বেশির ভাগ কৃষক আখ চাষে অনীহা প্রকাশ করছেন।

