বিদেশে অবস্থান করেও জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের জব্দ অ্যাকাউন্ট থেকে বিপুল অর্থ উত্তোলন করেছেন প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. এইচ বি এম ইকবাল। এই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্ত প্রতিবেদনে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনের সূত্রে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ডা. ইকবাল তার পরিবারের সদস্য—মইন ইকবাল, ইমরান ইকবাল, জামাল জি আহমেদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলনের জন্য বিশেষ পন্থা ব্যবহার করেছেন। এই অভিনব জালিয়াতিতে তাকে সহায়তা করেছেন প্রিমিয়ার ব্যাংকের বর্তমান এমডি আবু জাফর, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) সৈয়দ নওশের আলী এবং চিফ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসার (ক্যামেলকো) শামসুদ্দিন চৌধুরী। তদন্তে দেখা গেছে, এমডি আবু জাফর ফৌজদারি অপরাধেও জড়িত। তিনি অপকর্ম ঢাকতে ব্যাংকের সিসিটিভি ফুটেজও নষ্ট করেছেন।
২০২৪ সালের ১১ নভেম্বর বিকেল ৪টা ৯ মিনিটে বিএফআইইউ Government Anti-Money Laundering (GOAML) মেসেজ বোর্ডে অ্যাকাউন্ট জব্দের আদেশ পাঠায়। GOAML হলো একটি সুরক্ষিত সিস্টেম, যা ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও রিপোর্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগ নিশ্চিত করে। বিএফআইইউর নির্দেশ অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট জব্দের পরও এমডি আবু জাফর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার আড়ালে নির্দেশ বাস্তবায়নে বিলম্ব করেন। এরপরই বেআইনি পদ্ধতিতে ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ উত্তোলন করা হয়।
ডেপুটি চিফ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং কমপ্লায়েন্স অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে আদেশের কপি পান। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে শামসুদ্দিন চৌধুরীর কাছে কপি পৌঁছে দেন এবং অনুমতি চেয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে সব শাখায় প্রেরণের নির্দেশ দেন কিন্তু শামসুদ্দিন কপি নিয়ে এমডি আবু জাফরের কক্ষে যান। এর পরে এএমডি সৈয়দ নওশের আলীর কাছে কপি পৌঁছানো হয়।
সৈয়দ নওশের আলী প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন এবং কালক্ষেপণ শুরু করেন। এমডি আবু জাফর ও তার দুই সহচর শামসুদ্দিন এবং নওশের আলীর যোগসাজশে ডা. ইকবাল ও তার পরিবারের অ্যাকাউন্ট থেকে মোট ১ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং ৩০ হাজার ডলার (৩৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা) উত্তোলন করা হয়। মোট উত্তোলিত অর্থ দাঁড়ায় ১ কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট করা হয় যাতে অপরাধের প্রমাণ ধ্বংস হয়। এর ফলে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত তদন্তে বাধা তৈরি হয়েছে।
ঘটনা প্রকাশ পেয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংককে চলতি বছরের ১২ মে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা ও ৩০ হাজার ডলার জরিমানা করা হয়। ব্যাংকের এমডি সেই নির্দেশ অমান্য করে ব্যাংকের জেনারেল লেজার খাত থেকে জরিমানা জমা দেন। বিএফআইইউর অভিযোগে বলা হয়েছে, এমডি আবু জাফর, এএমডি সৈয়দ নওশের আলী এবং ক্যামেলকো শামসুদ্দিন চৌধুরী সম্পূর্ণভাবে জড়িত। এটি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ব্যবস্থার গুরুতর লঙ্ঘন।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের নতুন পরিচালনা পর্ষদ গত ১৯ আগস্ট গঠিত হয়। নতুন চেয়ারম্যান শেয়ারধারী আরিফুর রহমান বলেন, বিএফআইইউর নির্দেশ অমান্য ও জালিয়াতির ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাবেক প্রধান ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “বিএফআইইউর নির্দেশ অমান্য মানেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অমান্য করা। এটি দণ্ডনীয় অপরাধ। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “বিএফআইইউ তদন্ত করছে। নতুন নেতৃত্বে ব্যাংকটি ভালোভাবে পরিচালিত হবে। আশা করছি, অনিয়ম বন্ধ হবে।”

