দেশে মাদক প্রবেশ রোধে স্থলসীমান্তে নজরদারি কঠোর করলেও চোরাকারবারিরা সাগরপথকে প্রধান পথ হিসেবে ব্যবহার করছে। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মনে করছে, বর্তমানে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যে মাদকের প্রবেশ ঘটছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশই সাগরপথে আনা হচ্ছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ৮০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) টানা ১০ মাসের সংঘাতের পর ৮ ডিসেম্বর গত বছর জান্তা বাহিনীকে উৎখাত করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তও তাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। কিন্তু রাখাইনে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি সত্ত্বেও মাদক উৎপাদন বন্ধ হয়নি। বরং, জল ও স্থলসীমান্ত পেরিয়ে ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও অন্যান্য মাদক বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সীমান্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আরাকান আর্মি অস্ত্র ও রসদ জোগাতে মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা রোহিঙ্গাদের বাহক হিসেবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ সীমান্তে স্থলপথে কড়া নজরদারি বাড়ানোর পর পাচারকারীরা মূলত সাগরপথ ব্যবহার করছে। এই মাদক শুধুমাত্র বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্যান্য দেশে পাঠানোও হচ্ছে।
বিজিবি জানিয়েছে, মাছ ধরার নৌযান ব্যবহার করে সাগরপথে বাংলাদেশে মাদক প্রবেশ ঘটছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নাফ নদী ও সাগরের মাধ্যমে বাংলাদেশের নৌযান মিয়ানমারের অভ্যন্তরে যাতায়াতের দৃশ্য শনাক্ত করা গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিজিবি, কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী ও র্যাবের যৌথ অভিযানে প্রায় প্রতিদিনই সাগর উপকূলে বড় মাপের মাদক চালান জব্দ হচ্ছে। একই রুটে রাখাইন থেকে পাচারের সময় খাদ্যপণ্য, নির্মাণ সামগ্রী, ওষুধ ও জ্বালানি জব্দ করা হচ্ছে।
আটক ব্যক্তিদের দুই-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা নাগরিক। উদাহরণস্বরূপ, টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের স্লুইসগেট এলাকায় র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানে ৩ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবাসহ এক রোহিঙ্গা নাগরিক মো. ওমর সিদ্দিক (২৮) আটক হয়েছেন। এর আগে ১৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফের কায়ুকখালী ফিশারিঘাট এলাকায় মাছ ধরার ট্রলার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়।
এই অভিযানে টেকনাফের জাদিমুরা ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের মো. আনাছ (৪০) ও টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ার মো. সাদেক (১৯) আটক হন। একই দিনে হ্নীলা ইউনিয়নের দমদমিয়া সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ৪০ হাজার ইয়াবা বড়িসহ মিয়ানমারের বুথিডং এলাকার মো. ছলিম (৩০) আটক হন।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড জানায়, পাচারকারী চক্র বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য নিয়ে আসছে। ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাখাইনে পাচারের সময় টেকনাফের সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়া দ্বীপসংলগ্ন সমুদ্র এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্যসহ ১০ পাচারকারীকে আটক করা হয়। অভিযানে ধরা পড়েছিল ১০ হাজার কেজি ডাল, ২ হাজার ৫০০ কেজি রসুন, ১ হাজার কেজি টেস্টিং সল্ট, ২ হাজার ৫০০ কেজি পেঁয়াজ, ১ লাখ ৫০ হাজার মশার কয়েল ও ১০ হাজার রয়েল টাইগার এনার্জি ড্রিংকস।
এর আগে ১৬ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় অভিযান চালিয়ে কোস্ট গার্ড আরো একটি মাছ ধরার ট্রলার আটক করে। এফবি আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারি-১ নামে ট্রলার থেকে ১৫ হাজার কেজি আলু, ৭৫০ কেজি রসুন, ২ হাজার ৫০০ কেজি ময়দা, ২ হাজার ৫০০ কেজি মসুর ডাল, ১৪ হাজার ৪০০ পিস কোমল পানীয় (টাইগার-স্পিড), ৬০০টি গ্যাস লাইটার, ৮০০ পিস শেভিং ব্লেড, ৩টি মোবাইল ফোন, ১টি বাইনোকুলার, ১টি কম্পাস এবং ৪০০ ফুট কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। অভিযানে ১১ সদস্যকে আটক করা হয়।
কোস্ট গার্ড সদর দপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক জানিয়েছেন, পাচারকারী চক্র বাংলাদেশি খাদ্যপণ্যের বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য আনে। কোস্ট গার্ড চোরাচালান প্রতিরোধে অভিযান চালানোর পাশাপাশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
বিজিবি কক্সবাজার রিজিয়ন জানায়, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ, রামু এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২ কোটি ৩৪ হাজার ইয়াবা বড়ি, ১৪০ কেজি ক্রিস্টাল মেথ, ২৬ কেজি হেরোইন, প্রায় সাড়ে ৪ কেজি কোকেন এবং ৪ কেজি আফিমসহ অন্যান্য মাদক জব্দ করা হয়েছে। এসব মাদকের আনুমানিক মূল্য ১ হাজার ৩২২ কোটি টাকা। ১৫ জুলাই থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরো অন্তত ৩২ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করা হয়েছে।
সম্প্রতি সড়ক, রেল ও বিমানবন্দরে তল্লাশি ও নজরদারি বেড়ে যাওয়ায় সাগরপথ নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে। বিজিবির রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, নাফ নদী ও সাগর উপকূলীয় মহেশখালী, কুতুবদিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কুয়াকাটা এলাকা দিয়ে মাদক চোরাচালানের রুট তৈরি হয়েছে। এই রুটে মাছ ধরার ট্রলারে করে ৮০ শতাংশ মাদক আনা হচ্ছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. সাইফউদ্দিন শাহীন বলেন, মাদক ও খাদ্যপণ্য চোরাচালানের ২১-২২টি পয়েন্টে প্রযুক্তি ব্যবহার করে চোরাকারবারিদের শনাক্ত করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের ধরার পাশাপাশি হোতাদেরও আইনের আওতায় আনছে।
কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দী কয়েদির সংখ্যা ২ হাজার ৬৪৪ জন, যার মধ্যে ১ হাজার ১৪৮ জন মাদক মামলার আসামি। এদের মধ্যে ৪৫৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৪ জুলাই কক্সবাজারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিশেষ সভা আয়োজন করে। সভায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসিকে প্রধান করে ১৫ সদস্যের মাদকবিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ও কক্সবাজার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সৌমেন মণ্ডল বলেন, টাস্কফোর্স গঠনের পর মাদক উদ্ধার ও প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়েছে। সড়কপথে তল্লাশি ও নজরদারি বৃদ্ধি পেয়েছে। কক্সবাজার রেলস্টেশন ও বিমানবন্দরেও স্ক্যানার মেশিন বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম তৎপরভাবে চলছে।

