জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) বহির্গমন শাখা মূলত বিদেশগামী কর্মীদের বৈধ, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খলভাবে কর্মসংস্থানের দায়িত্বে নিয়োজিত। এই শাখাকে ‘রেস্ট্রিকটেড এরিয়া’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে সাধারণ নাগরিকের প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং প্রতিটি ফাইল যাচাই হয় নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে অফিসের নিয়মিত সময় শেষ হতেই এই স্বচ্ছ, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ পরিবর্তিত হয়ে যায়।
সন্ধ্যা নামতেই শাখার কার্যক্রমে প্রবেশ করে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে অসাধু সিন্ডিকেট, যারা নিয়মবিরোধীভাবে বিদেশগামী কর্মীদের পাসপোর্ট অনুমোদন ও ছাড়পত্রে হস্তক্ষেপ করে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসে নিজেরাই কাজ সারেন এজেন্সির মালিকরা। একদিনে ৭৯টি ফাইল অনুমোদন, জাল ও এডিট করা পাসপোর্ট দিয়ে ছাড়পত্র প্রদান—এসব কার্যক্রমের প্রমাণ হাতে রয়েছে। কিছু এজেন্সি সৌদিতে কর্মী পাঠানোর অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য শ্রমিক পাঠিয়েছে। এতে প্রবাসী কর্মীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
এছাড়াও সরকারি সার্ভারে অসাধু চক্রের অবাধ প্রবেশের কারণে নাগরিকদের তথ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। নিয়ম, নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতার মুখোশের আড়ালে এই অনিয়মের কার্যক্রম চলছেই।
বিএমইটির বহির্গমন শাখা বৈধ চুক্তিপত্র যাচাই করে বিদেশগামী কর্মীদের ক্লিয়ারেন্স প্রদান করে। তাদের অনুমোদন ছাড়া কেউ বিদেশে কাজ করতে যেতে পারেন না। এ শাখার দায়িত্বে রয়েছে রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যক্রম তদারকি, চুক্তির শর্ত বিশ্লেষণ ও কর্মীদের অধিকার রক্ষা।
এছাড়াও তারা প্রতিটি বিদেশগামী কর্মীর তথ্য ডাটাবেজে সংরক্ষণ করে, যাতে ভবিষ্যতে সরকারি সহায়তা প্রদান সহজ হয়। তদুপরি, প্রতারণা বা জাল কাগজপত্র শনাক্ত করা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এ শাখার কাজের অংশ। অনলাইন সেবার মাধ্যমে সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বহির্গমন ক্লিয়ারেন্স প্রদান করা হয়। এজন্যই এই শাখাকে ‘রেস্ট্রিকটেড এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও, বহির্গমন সংক্রান্ত অভিযোগ জানাতে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও সময় নির্ধারিত আছে।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব নিয়ম শুধুমাত্র যারা বৈধভাবে কাজ করছেন তাদের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যদিকে, এক অসাধু সিন্ডিকেট নিয়ম উপেক্ষা করে নিজের খেয়ালখুশিমতো কাজ চালায়। তারা রেস্ট্রিকটেড এলাকায় অবাধে প্রবেশ করতে পারে। অফিস সময় শেষে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে যায়। সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসে নিজেদের ফাইল অনুমোদন করান এবং অনিয়মে জড়িত থাকায় তদারকিও কার্যকর হয় না। এর ফলে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
এছাড়া সরকারি সার্ভারে অসাধু চক্রের অবাধ প্রবেশ নাগরিকদের তথ্য অনিরাপদ করে তুলেছে। কালবেলার হাতে এমন বেশ কিছু ভিডিওও রয়েছে, যা জুলাই ও আগস্ট মাসে বিভিন্ন সময়ে ধারণ করা হয়েছে।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, টি-২০ ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ১৪১৫) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান আক্তার ‘প্রবেশ নিষেধ’ বহির্গমন শাখা থেকে বের হচ্ছেন। নুরজাহানের বিরুদ্ধে বিএমইটিতে নানা প্রতারণা ও অনিয়মের অভিযোগে দুদকে একাধিক মামলা রয়েছে।
অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, দি ইফতি ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ৮৯৪) ব্যবস্থাপনা অংশীদার মো. রুবেল বহির্গমন শাখায় প্রবেশ করছেন, যেখানে দরজার সামনে থাকা প্রহরী তাকে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন। একইভাবে তাকওয়াহ ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ১৯৪৫) ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিমকে শাখার ভেতরে দাঁড়িয়ে কাজ করতে দেখা গেছে।
এছাড়াও এমএস মক্কা ওভারসিজের (আরএল নম্বর: ১১৭৫) মো. জামাল হোসেন ও মিজান সলিউশন সার্ভিসের (আরএল নম্বর: ২৭৭৮) মো. মিজানুর রহমান শাখায় নিয়মবিরোধীভাবে প্রবেশের দমনমূলক কার্যক্রমে জড়িত।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এই এজেন্সিগুলোর ইতিহাস খুঁজে নিয়মবিরোধীভাবে শত শত কর্মীকে বিদেশে পাঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। উদাহরণস্বরূপ, মিজান সলিউশন সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও অসংখ্য শ্রমিক পাঠিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যবহার হওয়া কিছু পাসপোর্ট নম্বর হলো এ০১২০৯৪৬৬, এ১৪৪৭৪৪৩, এ০২৮৪২২৮০, এ০৩৭৬৮৪৮৩, এ০৫০৯০৪১১, এ০৫৯৮৬২৭৮, এ০৬৫৭৪৫৬৩, এ০৭৩২৪০৮৭, এ০৭৯৯১৫০২, এ০৮৬১৩৫৬০, এ০৮৬১৯৬০৭, এ০৮৯২৪৩৫৯, এ১২৪৮২৪৫৭, এ১৫৩১৮৭৯০, এ১৫৬৭২৬৬৭, এ১৬০৯৯৬৯০, এ১৬১২০৪৮৩, এ১৬২২৪৫৪৭, এ১৬৪৯৩৭৯২, এ১৬৮৯০২২৮, ইজে০৮৩৩৩৪১ ও ইএল০৭২৩২০১।
মিজান সলিউশন সার্ভিসের মো. মিজানুর রহমান মোবাইলে (সূত্র) সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, ‘বিগত সরকারের সময় আমার লাইসেন্স ব্যবহার করে কেউ কাজ করেছে। আমি নিজে সৌদি আরবে কোনো লোক পাঠাইনি। যারা করেছে, তাদের খুঁজছি।’ ৬ ফেব্রুয়ারি তার লাইসেন্স থেকে ২২ জন কর্মী সৌদি আরবের ছাড়পত্র পেল কীভাবে—এ বিষয়ে তিনি অবগত নন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএমইটিকেন্দ্রিক অসাধু সিন্ডিকেটের প্রধান নিয়ন্ত্রক হলেন টি-২০ ওভারসিজের নুরজাহান আক্তার ও দি ইফতি ওভারসিজের মো. রুবেল। তারা অন্তত ৫০টি এজেন্সির হয়ে দালালি করে। নুরজাহান আগে বিএমইটির তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা ছিলেন এবং চাকরিকালীন সময়ে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। চাকরি হারানোর পরও তিনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে মানব পাচারের ভয়ংকর চক্র তৈরি করেন। তাদের মাধ্যমে বিদেশে নিয়মবিরোধীভাবে শ্রমিক পাঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
নুরজাহান ও রুবেল স্বতন্ত্রভাবে এবং নিজেদের এজেন্সির বাইরেও নিয়মবিরোধীভাবে কাজ চালান। যেমন, ২০ মে একই দিনে নুরজাহান আক্তারের ৭৯টি ফাইল অনুমোদন হয়। ১৭ মার্চ রুবেলের দি ইফতি এজেন্সি থেকে একই দিনে ২০টি ফাইল অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়াও ভুয়া পাসপোর্ট নম্বর বসিয়ে নারী শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর প্রমাণও রয়েছে।
মো. রুবেল বলেন, ‘আমি অন্য কোনো লাইসেন্সে কাজ করি না। এ অভিযোগ মিথ্যা। বহির্গমন শাখায় ঢোকার বিষয়টি স্বীকার করি, আমাদের কাজের প্রয়োজনে ডিরেক্টর স্যারের অনুমতি নিয়ে যাই।’ বিএমইটির বহির্গমন শাখার পরিচালক (উপসচিব) মো. তাজিম-উর-রহমান বিষয়টি অস্বীকার করেছেন এবং জানান, গেটম্যানকে বদলি করা হয়েছে।
এছাড়া, এমএস মক্কা ওভারসিজের ১৯ মার্চ অনুমোদিত ৯টি ফাইলেও জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে ছাড়পত্র প্রদানের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মো. জামাল হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তাকওয়াহ ওভারসিজের বিরুদ্ধে শতাধিক নিয়মবিরোধী ফাইলের তথ্য কালবেলার কাছে রয়েছে।
বিএমইটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘নুরজাহান আক্তার সবচেয়ে বেপরোয়া। তিনি আগে এখানে চাকরি করেছেন বলে কর্মকর্তারা কিছু বলতেই পারেন না। অ্যাপ্রোভ না হলে তিনি কর্মকর্তাদের রুমে গিয়ে বসে থাকেন। দুদক তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে। তবে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখনই এই চক্র বন্ধ করা প্রয়োজন।’
ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল ইসলাম হাসান বলেন, ‘স্পর্শকাতর তথ্য থাকার কারণে বিভাগটি রেস্ট্রিকটেড। এখন সেখানে অবাধ যাতায়াত হলে রেস্ট্রিকটেড থাকার অর্থ থাকে না। সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসে কেউ কাজ করলে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। অবৈধ সুবিধা নেওয়া হলে আইনের আওতায় আনা উচিত। অনিয়মে যদি কর্মকর্তারা জড়িত থাকেন, তাহলে ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে যায়।’
গত ১ সেপ্টেম্বর বিএমইটির মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফর নিজ কার্যালয়ে ভিডিও ও তথ্য দেখে জড়িত কর্মকর্তাদের শনাক্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তিনি সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন।
সূত্র: কালবেলা অনুসন্ধান/বিএমইটি