দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখন নতুন করে পেয়েছে ‘আন্দোলনের সূতিকাগার’ তকমা। একের পর এক গণবিক্ষোভে নড়বড়ে হয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশের সরকার। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও সর্বশেষ নেপালে বিক্ষোভের চাপেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে সরকার। মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনেও বিক্ষোভ চলছে। অস্থিরতার ছায়া পড়েছে এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও।
এই ধারাবাহিক গণআন্দোলনের পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে এসেছে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব দুর্নীতির অর্থের বড় অংশই পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। তার বেশির ভাগই স্থানান্তরিত হয়েছে যুক্তরাজ্যে। আন্তর্জাতিক পরিসরে লন্ডন এখন হয়ে উঠেছে ক্লেপ্টোক্রাটসদের নিরাপদ আস্তানা। দুর্নীতির টাকা সেখানেই পাচার হয়ে জমছে এবং সেই অর্থে গড়ে উঠছে বিলাসবহুল সম্পত্তি।
চীনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট সম্প্রতি এই ইস্যুতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গতকাল সোমবার প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আশপাশের অঞ্চলের দুর্নীতির টাকা কীভাবে লন্ডনে আশ্রয় পাচ্ছে, তা নতুন করে সামনে এসেছে মালয়েশিয়ায় শুরু হওয়া এক তদন্তের সূত্র ধরে। এই তদন্ত আবারও প্রশ্ন তুলেছে—লন্ডন কেন দুর্নীতির অর্থ লুকানোর এত বড় নিরাপদ ঘাঁটি হয়ে উঠল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গণআন্দোলনগুলো তাই শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের নয়, বরং বৈশ্বিক আর্থিক স্বচ্ছতারও নতুন আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদের লন্ডনভিত্তিক সম্পত্তির উৎস নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। মাহাথির অবশ্য দাবি করেছেন এসব সম্পত্তি অবৈধ নয়। তবে চলতি বছরের জুনে মালয়েশিয়ার দুর্নীতি দমন কমিশনের (এমএসিসি) অনুরোধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ প্রয়াত ধনকুবের ও মাহাথিরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী দাইম জায়নুদ্দিনের প্রায় ১৮ কোটি ডলার মূল্যমানের সম্পত্তি ফ্রিজ করে। জব্দ হওয়া সম্পত্তির তালিকায় রয়েছে লন্ডন সিটি এলাকার দুটি বাণিজ্যিক ভবন। আছে মেরিলেবোন ও বেইজওয়াটারের বিলাসবহুল বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট।
মালয়েশিয়ার ঘটনা শুধুই একটিমাত্র কেস নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও দুর্নীতির অর্থ ব্রিটেনে স্থানান্তরের চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই দেখা গেছে। বিশ্লেষকের মতে এসব টাকা প্রায়ই বৈধ সম্পদের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়। শেল কোম্পানি ও অফশোর কাঠামোর মাধ্যমে অর্থ এমনভাবে নড়াচড়া করে যে উৎস খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। এই ধরনের লেনদেন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পদ গঠনের বিষয় নয়। এর কারণে গ্লোবাল আর্থিক স্বচ্ছতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্নীতির অর্থ শোধ করে বৈধ অর্থের আড়ালে ঢোকানো হলে স্থানীয় অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব পড়ে। আন্তর্জাতিক তদন্ত ও তথ্য বিনিময় না বাড়ালে এমন লেনদেন বন্ধ করা কঠিন। বিশেষভাবে রিয়েল এস্টেটের মতো সেক্টরে তদারকি জোরদার করা দরকার। শেল কোম্পানি ও অনামী মালিকানার চেন চিহ্নিত করতে করপোরেট স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।
মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যের এই মামলা নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—কেন লন্ডন দুর্নীতির অর্থের জন্য এত বড় আস্তানা হয়ে উঠেছে এবং কৌশলগত পরিবর্তন ছাড়া এই প্রবণতা থামবে না। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল ওয়ানএমডিবি থেকে যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পত্তি কেনা হয়েছে। এসব অর্থ ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে আসে। দ্বীপপুঞ্জটি বিশ্বে ‘ট্যাক্স হেভেন’ নামে পরিচিত, যেখানে করের হার প্রায় শূন্য এবং গ্রাহকের আর্থিক গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়।
তবে যুক্তরাজ্যে অর্থ পাচারের অভিযোগে কেবল মালয়েশিয়াই নয়, বাংলাদেশের নামও উঠে এসেছে। গত মে মাসে ব্রিটিশ ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের বিলাসবহুল সম্পত্তি জব্দ করে। ধারণা করা হচ্ছে, এই সম্পত্তি বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মালিকানাধীন।
যুক্তরাজ্যের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল তদন্ত করে প্রায় ৪০ কোটি পাউন্ড মূল্যের আরও সম্পত্তির খোঁজ পায়। জানা যায়, এসব সম্পত্তিও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যুক্ত। তালিকায় রয়েছে লন্ডনের মে ফেয়ার ম্যানশন, সারে কাউন্টির এস্টেট ও মার্সিসাইডের ফ্ল্যাট।
এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, বছরের পর বছর ধরে অলিগার্ক ও স্বৈরশাসকদের জন্য লাল গালিচা বিছানো হয়েছে, যাতে তারা অবৈধ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করতে পারে। এশিয়াজুড়ে এমন ঘটনার আরও দৃষ্টান্ত রয়েছে। গত বছর সিঙ্গাপুরে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মানি লন্ডারিং মামলায় এক চীনা নাগরিক কারাদণ্ড পান। ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে দুজন অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ৫৬ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি কেনেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, ক্যারিবীয় সাগরের পাঁচটি অঞ্চল—কেম্যান দ্বীপপুঞ্জ ও ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জসহ—এখনও বৈশ্বিক মানি লন্ডারিং চক্রের প্রধান অংশ। গত ৩০ বছরে এসব অঞ্চলের মাধ্যমে ৭৯টি দেশ থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে।
আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও বহু দশক ধরে লন্ডন অজানা উৎসের অর্থের নিরাপদ বিনিয়োগস্থল হিসেবে পরিচিত। কালোটাকা সাদা করার ‘লন্ড্রোম্যাট’ খ্যাতি এ শহরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেকদিন। নিয়মিত অভিযোগ উঠলেও যুক্তরাজ্য আইনি ব্যবস্থা নিতে ধীরগতিই দেখিয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ক্যারিবীয় অঞ্চলের পাঁচটি ব্রিটিশ ওভারসিজ টেরিটরি—যার মধ্যে কেম্যান আইল্যান্ডস ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস রয়েছে—এখনো বৈশ্বিক অর্থ পাচারের বড় কেন্দ্র। তাদের হিসাব অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে এসব অঞ্চলের মাধ্যমে ৭৯টি দেশ থেকে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড অবৈধ অর্থ পাচার হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে দুর্নীতি, কালোটাকা পাচার ও অবৈধ সম্পদ বিনিয়োগের বিরুদ্ধে লড়াই দীর্ঘদিন ধরেই চলছে কিন্তু বাস্তবতা হলো, অর্থ পাচারকারীরা আজও বিভিন্ন অফশোর অঞ্চল আর উন্নত দেশগুলোর নীরবতা ব্যবহার করে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিচ্ছে। মালয়েশিয়ার ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বিতর্কিত সম্পদ কিংবা সিঙ্গাপুরে চীনা নাগরিকদের জড়িত মানি লন্ডারিং—সব কিছুরই গন্তব্য প্রায় একই: লন্ডন ও তার সহযোগী ট্যাক্স হেভেনগুলো।
আন্তর্জাতিক চাপ ও সমালোচনা বাড়লেও আইনি পদক্ষেপ এখনো শ্লথ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের পর্যবেক্ষণ বলছে, ধনী অলিগার্ক ও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর জন্য পশ্চিমা বিশ্ব লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। এতে শুধু উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাও ঝুঁকির মুখে পড়ছে।
অতএব প্রশ্ন থেকে যায়—আইনের দুর্বলতা আর রাজনৈতিক আপসের সুযোগে যদি অর্থ পাচারকারীরা এভাবে বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রগুলোতে নিরাপদ বিনিয়োগের জায়গা পায়, তবে এই ‘লন্ড্রোম্যাট’ চক্র ভাঙবে কীভাবে?