অপহরণের
দেশে অপহরণসংক্রান্ত অপরাধের হার গত এক বছরে উদ্বেগজনকভাবে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে অপহরণের শিকার হয়েছেন ৭১৫ জন। তুলনামূলকভাবে, গত বছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৪০। এভাবে দেখা যায়, দৈনিক গড়ে তিনজনের বেশি মানুষ বর্তমানে অপহরণের শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের প্রকাশিত মাসিক অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই চিত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতির ইঙ্গিত দেয়। সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, “প্রতি মাসে অপরাধের তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে আমরা সমসাময়িক অপরাধের প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করি। কিছু অপরাধ বৃদ্ধি পেলে আমরা তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করি।”
অপহরণের গতিশীলতা-
২০২৪ সালে দেশের মোট অপহরণের সংখ্যা ছিল ৬৪২। মাস ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে ৫১ জন, ফেব্রুয়ারি ৪৩ জন, মার্চ ৫১ জন, এপ্রিল ৫৫ জন, মে ৫০ জন, জুন ৩১ জন, জুলাই ৩২ জন, আগস্ট ২৭ জন, সেপ্টেম্বর ৬৫ জন, অক্টোবর ৯৬ জন, নভেম্বর ৬৭ জন এবং ডিসেম্বর ৭৪ জন।
এই তথ্য অনুযায়ী, প্রথম আট মাসে অপহরণের সংখ্যা ৩৪০, যা মাসে গড়ে ৪২.৫ জন। চলতি বছরের একই সময়ে মাসিক গড় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.৩৮ জন, যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি।
বিশেষভাবে, চলতি বছর জুলাই মাসে ১০৯ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) অনুযায়ী গত ছয় বছরের মধ্যে একক মাস হিসেবে সর্বোচ্চ রেকর্ড।
এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১০৫ জন, ফেব্রুয়ারি ৭৮ জন, মার্চ ৮৩ জন, এপ্রিল ৮৮ জন, মে ৮২ জন, জুন ৮০ জন এবং আগস্টে ৯০ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন।
সিজিএসের ‘বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টস ২০২০-২৫; এ ডেটা-ড্রাইভেন লুক অ্যাট রাইজিং ক্রাইম ট্রেন্ডস’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “২০২৫ সালে মাসিক গড়ে অপহরণের ঘটনা ৮৬.১৭টি, যা ২০২৪ সালে ছিল ৫৩.৫। আগের বছরের তুলনায় অপহরণ বেড়েছে ৬১.০৭ শতাংশ। এটি গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড।”
অপরাধ ও মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষণ-
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারম্যান জেড আই খান পান্না জানিয়েছেন, “মামলার সংখ্যা যেখানে দেখা যায়, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে অনেক বেশি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে মামলা করা সম্ভব হয় না। দেশে আইনের শাসন নেই, ফলে অপরাধও কমেনি বরং বেড়েছে।”
অপরাধবিষয়ক পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ থেকে দেখা গেছে, গত বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে অপহরণের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। শেষ চার মাসে দিনে গড়ে ২.৫২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর ফলে ওই বছরের দৈনিক গড় অপহরণের সংখ্যা দাঁড়ায় ১.৭৬। ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে দৈনিক গড়ে অপহরণের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৯৮ জন। ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ছিল ১.৩৩।
সামাজিক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, “যখন কোনো অপরাধ বৃদ্ধি পায়, তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রায়শই বৈধতা দেওয়ার ব্যাখ্যা দেয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে এ ধরনের ব্যাখ্যা অপরাধীদের সুযোগ দেয়। রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশ ব্যবহৃত হলে ভিন্ন দল ও মতের ওপর দমন হয়, ফলে সমাজে অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। গড়ে দৈনিক তিনজন অপহরণ হওয়া দেশের আইনের শাসনের বড় ঘাটতির প্রমাণ।”
অপরাধের পেছনের কারণ-
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক ও পারিবারিক শত্রুতা, অর্থনৈতিক চাপ, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির মতো নানা কারণে সমাজে অপহরণ সংঘটিত হয়। তবে বেশির ভাগ অপহরণের পেছনে অর্থনৈতিক কারণ সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। অনেক পরিবার একজন উপার্জকের ওপর নির্ভরশীল। উপার্জন বন্ধ হলে পরিবারের সদস্যরা সঞ্চয় শেষ করে এবং ঋণ গ্রহণ করে। এর ফলে অপরাধে জড়িয়ে পড়া সহজ হয়ে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৫ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা বেড়ে এক লাখ ৬০ হাজার হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ২০ হাজার। অর্থনৈতিক সমস্যা ও কর্মসংস্থানের অভাব অপরাধ বৃদ্ধির পেছনের অন্যতম কারণ।
সাম্প্রতিক অপহরণের ঘটনা-
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
- চট্টগ্রাম, পটিয়া: ১৭ সেপ্টেম্বর মুরগি ব্যবসায়ী নুরুল আবছারকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় অপহরণকারী। তাঁর পকেটে থাকা ৪০ হাজার টাকা চুরি করা হয় এবং পরে মুক্তিপণ হিসেবে ১৭ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পুলিশের তৎপরতায় দুই ঘণ্টার মধ্যে তিনি উদ্ধার হন।
- কুমিল্লা: অপহরণের ৩৬ দিন পর রিকশাচালক মেহেদী হাসানের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। অভিযুক্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপহরণকারীরা স্বীকার করেছেন, মেহেদীকে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়েছে।
- শিবগঞ্জ, দাইপুকুরিয়া-বাগবাড়ী: শাওবান হোসেনের ছেলে মো. সানি আহম্মেদ ১৫ সেপ্টেম্বর অপহরণের শিকার হন। আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে।
সমগ্র চিত্র-
সংখ্যাগত তথ্য ও সাম্প্রতিক ঘটনা প্রমাণ করে, দেশে অপহরণ একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। এটি শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার হুমকি নয়, বরং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, মানবাধিকার সংস্থা এবং নীতিনির্ধারকদের একযোগে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন, যাতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
সূত্র: বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)

