ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হতে যাচ্ছে সৌদাবেহ জরগাহম নেজাদের নাম। কুর্দিস্তান প্রদেশের প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা ইরানের প্রশাসনিক কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ইরানের নারী মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজেরানি এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, “এই নিয়োগ নারীর ক্ষমতায়নের প্রতি ইরান সরকারের অঙ্গীকার ও নারীদের দক্ষতার স্বীকৃতি।”
সৌদাবেহ জরগাহম নেজাদের এই নিয়োগ ইরানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নারীদের জন্য সরকারি পদগুলোতে সমান সুযোগ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন। তার সরকারের মূল লক্ষ্যগুলোর একটি ছিল প্রশাসনিক ও সরকারি পদগুলোতে নারীদের আরও অন্তর্ভুক্ত করা এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা। সৌদাবেহের নিয়োগ সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
এর আগে, সৌদাবেহ জরগাহম নেজাদ কুর্দিস্তান গভর্নর জেনারেলের কার্যালয়ের নারী বিষয়ক বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেখানে তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক উন্নয়ন এবং নারীদের জন্য বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। তার এই কাজ এবং নেতৃত্বের জন্যই তাকে গভর্নরের পদে উন্নীত করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জরগাহম নেজাদের নিয়োগ কুর্দিস্তান প্রদেশের নারীদের জন্য একটি নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে এবং প্রশাসনে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
ইরানে নারীদের জন্য সরকারি পদে নিয়োগ সবসময়ই চ্যালেঞ্জিং ছিল। বিশেষ করে কুর্দিস্তানের মতো প্রদেশগুলোতে, যেখানে ঐতিহ্যগতভাবে নারীরা প্রশাসনিক উচ্চপদে খুব কমই পৌঁছাতে পেরেছেন। জরগাহম নেজাদের নিয়োগ এই ধারা ভাঙার এক সাহসী পদক্ষেপ। ইরানে বর্তমানে নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে, ব্যবসায়িক উদ্যোগে এবং সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তবুও সরকারি উচ্চপদে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত ছিল। এই নিয়োগ সেই সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সৌদাবেহ জরগাহম নেজাদের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ এমন এক সময়ে এলো, যখন ইরান এক সামাজিক উত্তাল পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। দুই বছরেরও বেশি সময় আগে কুর্দি বংশোদ্ভূত তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর সারা ইরানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয়। মাহসা আমিনির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এই আন্দোলন পরবর্তীতে সহিংসতায় রূপ নেয়, যেখানে বিদেশি মিডিয়া এবং বিভিন্ন এজেন্টদের দায়িত্বপ্রাপ্ত বলে অভিযোগ ওঠে। এই আন্দোলন ইরানের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে নাড়া দেয়।
তবে, এমন পরিস্থিতিতেও সৌদাবেহ জরগাহম নেজাদের নিয়োগ ইরান সরকারের একটি সাহসী পদক্ষেপ। এটি ইরানের প্রশাসনিক কাঠামোতে নারীদের ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়া জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে ধরা হচ্ছে। বিশেষ করে কুর্দি জনগোষ্ঠীর নারী হিসেবে তার এই নিয়োগ আরও তাৎপর্যপূর্ণ। কুর্দি জনগোষ্ঠীর জন্য এটি শুধু একটি প্রশাসনিক সাফল্য নয় বরং তাদের অধিকারের জন্য চলমান সংগ্রামে একটি গৌরবময় মাইলফলক।
সৌদাবেহ জরগাহম নেজাদের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ ইরানে নারীর ক্ষমতায়নের নতুন যুগের সূচনা করেছে। বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারীদের জন্য এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। ইরানে নারীদের অবস্থান ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রচেষ্টায় এটি এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ভবিষ্যতে ইরানের অন্যান্য প্রদেশেও নারীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হলে নারীর ক্ষমতায়নের ধারাকে আরও সুসংহত করা সম্ভব হবে।
এখন সময়ই বলে দেবে, সৌদাবেহ জরগাহম নেজাদ তার নতুন দায়িত্ব কতটা সাফল্যের সঙ্গে পালন করতে পারেন, তবে তার নিয়োগ নিঃসন্দেহে ইরানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।