বাজারের “অদৃশ্য হাত” শব্দটি প্রায়ই অর্থনৈতিক তত্ত্বে ব্যবহৃত হয় । অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের “অদৃশ্য হাত” ধারণাটি মূলত একটি রূপক, যা তিনি তার বিখ্যাত রচনা দ্য ওয়েলথ অব নেশনস (১৭৭৬)- এ প্রথম তুলে ধরেন। এই তত্ত্বের মাধ্যমে স্মিথ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাজার নিজেই এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় ভারসাম্য রক্ষা করে। ব্যক্তি যখন তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করে, তখন তারা একই সাথে সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির পথে ভূমিকা (তা নেতিবাচক হোক বা ইতিবাচক) রাখে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। আর সেখানেই কাজ করে স্মিথের বর্ণিত সেই ” অদৃশ্য হাত ” কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে অদৃশ্য হাত অবশ্যই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত।
অ্যাডাম স্মিথের এই ধারণা মূলত মুক্তবাজার ব্যবস্থার পক্ষে থাকলেও বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে বাংলাদেশের বাজারে এই ” অদৃশ্য হাত ” এর উপস্থিতি জনগণের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্রুত বাড়ছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে উঠছে। অথচ এর প্রকৃত কারণ নিয়ে সবার মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা রয়েছে। বাজারের এই অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আসলে কী কাজ করছে- চাহিদা ও সরবরাহের বিশৃঙ্খলার অদৃশ্য শক্তি , নাকি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতের ছোঁয়া তা সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রশ্ন তুলছে বারবার।
বাজারের প্রভাবকরা কারা?
মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সবচেয়ে বড় প্রভাবক হলো চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে অসামঞ্জস্য। যখন বাজারে কোনো পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে কিন্তু সরবরাহ কম থাকে, তখন সেই পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক সময় দেখা যায়, এই চাহিদা ও সরবরাহের চক্র থেকে বেরিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। যা বাজারের স্বাভাবিক নিয়মকে বিঘ্নিত করে। বিশেষ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা পণ্য মজুদ করে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে। যার ফলে দাম বাড়ে এবং সাধারণ মানুষ তার ভুক্তভোগী হয়।
এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, বাজারের অদৃশ্য হাত কি প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করছে নাকি এটি অসাধু গোষ্ঠীর কৌশল দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে । আমরা জানি, বাজারের মূল্যবান পণ্যসমূহের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে মধ্যস্বত্বভোগীরা তাদের ইচ্ছামতো বাজারে সংকট সৃষ্টি করে। এর ফলে বাজারের স্বাভাবিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং সাধারণ ক্রেতারা একধরনের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হন । যেখানে ন্যায্য মূল্যে পণ্য পাওয়া তাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর আমাদের নির্ভরতা। তেল, গ্যাস, সার এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তখন তার প্রভাব সরাসরি দেশের ভেতরে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে এবং আমদানি খরচ বাড়ায় দেশের ভেতরে দামও বেড়ে গেছে।
এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মান বৃদ্ধি পেয়েছে। যা আমদানি খরচ বাড়ানোর আরেকটি বড় কারণ। এই মূল্যবৃদ্ধির সাথে দেশের বাজারের কোনো সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। ফলে বাজারের অদৃশ্য হাত এখানে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির এক অদৃশ্য শক্তি হিসেবে কাজ করছে এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
বাংলাদেশ বিগত দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতির জটিল ফাঁদে আটকে আছে। যা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এই সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যাটি এসেছে মূলত দেশের বাইরে থেকে, ঠিক যেমন কভিড-১৯ এসেছিল। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে, তখন মূল্যস্ফীতির গতি দেশে আরও তীব্র হয়। যুদ্ধের আগের সময়টিতে মূলতঃ কভিড-১৯ এর প্রভাব কাটিয়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে ছিল। কিন্তু সেই সময় থেকেই ভোগ্য পণ্য, শিল্প উৎপাদনের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এবং বাণিজ্য সহায়ক সেবার মূল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক গভীর প্রভাব ফেলে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর নীতি গ্রহণ করা জরুরি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
বাজারে মূল্যবৃদ্ধির আরেকটি রহস্যময় দিক হলো- কৃত্রিম সংকট তৈরি করা। অনেক সময় দেখা যায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাজার থেকে পণ্য সরিয়ে নিয়ে সংকট সৃষ্টি করে। অসাধু ব্যবসায়ীদের নিজে থেকে পণ্যের দাম বাড়ানো আমাদের জীবনের একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে সরবরাহ কমে যায় এবং দাম বেড়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে বাজারের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং সাধারণ মানুষ বাধ্য হয় বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে।
বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদন বেশিরভাগ সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে কৃষিপণ্যের উৎপাদন হ্রাস পায়। যা সরাসরি বাজারে প্রভাব ফেলে। সরবরাহ কমে গেলে পণ্যের দাম বাড়ে। এছাড়াও কৃষি পণ্যের সঠিক সংরক্ষণ এবং পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় প্রায়ই বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়। তাই কৃষি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তি ও সঠিক পরিকল্পনার
এই সমস্যা সমাধান কল্পে অদৃশ্য হাতের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের সঠিক মনিটরিং এবং কার্যকর নীতি প্রণয়ন প্রয়োজন। মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমাতে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে ভোক্তাদের যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কৃষকরা ন্যায্য দাম পায় এবং সাধারণ মানুষ ন্যায্য মূল্যে পণ্য কিনতে পারে।
সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধির এই চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
বাংলাদেশের বাজারের অদৃশ্য হাতের নিয়ন্ত্রণ যদি স্বাভাবিকভাবে চলত, তাহলে হয়তো সাধারণ মানুষের কষ্ট কম হতো। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, এই অদৃশ্য হাত কোনো নির্দিষ্ট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির এই রহস্য উদঘাটনে প্রয়োজন বাজারে কর্তৃপক্ষের মনিটরিং বাড়িয়ে, বাজার নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যেখানে সাধারণ জনগণের কল্যাণই হবে মূল লক্ষ্য।