ঢাকাকে বাংলাদেশের হৃদয় বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের হৃদয় এই প্রাণকেন্দ্রটি আজ এক জটিল সংকটের মুখোমুখি-পানির সংকট। বিশুদ্ধ পানি যা মানুষের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য, সেটি শহরের বহু নাগরিকের কাছে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।
ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষ এই সমস্যার শিকার হচ্ছে এবং এর সমাধান যেন ক্রমেই জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার দাবি, ঢাকায় পানির যে চাহিদা ও উৎপাদন তার চেয়ে বেশি। ওয়াসার তথ্যানুযায়ী, শহরের প্রতিটি এলাকায় সমানভাবে পানি সরবরাহের জন্য ‘রেশনিং’ ব্যবস্থা পুরোপুরি কার্যকর নয়। এর ফলে কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে পানি সংকট দেখা দেয়। যখন কোনো এলাকায় পানি সংকট দেখা দেয় বা গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে পড়ে। তখন পাশের এলাকা থেকে পানি সরবরাহ করে চাহিদা পূরণ করা হয়। এই পদ্ধতিটিই ‘রেশনিং’ নামে পরিচিত, যা সংকটময় সময়ে সাময়িক সমাধান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ঢাকার পানির সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে এ সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।
ঢাকায় পানি সংকটের কারণ-
ঢাকায় পানির সংকটের পেছনে মূলত কয়েকটি কারণ দায়ী। ঢাকায় জনসংখ্যা প্রায় ৪,৪২,১৫,১০৭ জন। প্রতিদিন শহরে নতুন নতুন লোক প্রবেশ করছে। যার ফলে সেবাসমূহের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। পানি সরবরাহের সক্ষমতা জনসংখ্যার এই বিশাল চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। শহরের জলবায়ুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রয়োজন।
আবার ঢাকার পানির প্রধান উৎস ভূগর্ভস্থ জলস্তর, যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। সাধারণত গরম আবহাওয়া বিগত বছরগুলোরতে দিনে ২৫০ থেকে ২৬০ মিলিয়ন লিটার পানি প্রয়োজন হয় । কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ২৮০ মিলিয়ন লিটারের বেশি পানি ব্যবহৃত হচ্ছে। যার ফলে ভূগর্ভস্থ স্তর পুনরায় পূর্ণ হওয়ার যথেষ্ট সময় পাচ্ছে না। ফলে পানির স্তর প্রতি বছর ২-৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনক।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা এবং বালু নদী ঢাকার প্রধান পানির উৎস হলেও এসব নদীর পানি এখন প্রচণ্ড দূষিত। কলকারখানার বর্জ্য, গৃহস্থালি ময়লা এবং রাসায়নিক পদার্থ মিশে নদীগুলোর পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে প্রাকৃতিক পানি উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৬ নম্বর লক্ষ্যটি হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে সকল নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করা। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ মানুষের কাছে পানির কোনো না কোনো উৎস রয়েছে। তবে, এই উৎসগুলোর মধ্যে সব পানি নিরাপদ নয়। বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী, মাত্র ৫৬ শতাংশ মানুষ নিরাপদ ও সুপেয় পানি পাচ্ছে। ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ মনিটরিং প্রোগ্রামের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সুপেয় পানির সাপ্তাহিক হিসাব ৮৭ শতাংশ। কিন্তু যখন পানির দূষণ বিবেচনায় নেওয়া হয় তখন দেখা যায়, ৪৪ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির আওতার বাইরে রয়েছেন। এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের সামনে বাংলাদেশের, বিশেষত ঢাকার পানি সংকটের সুস্পষ্ট চ্যালেঞ্জ তুলে ধরছে।
বর্তমান পরিস্থিতি-
ঢাকার পানির সংকট দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে। অনেক এলাকায় নির্দিষ্ট সময়ে পানি সরবরাহ হলেও তা পর্যাপ্ত নয় এবং কিছু ক্ষেত্রে তা দূষিত হয়ে আসে। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং জলাধারগুলোর দূষণ এই সংকটকে আরও প্রকট করছে। অনেক এলাকা পানির লাইনে ফাটল এবং লিকেজ থাকায় পাইপলাইনের মাধ্যমে দূষণ ছড়ায়। এতে করে মানুষের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, নিরাপদ পানির অভাব বিশেষ করে নিম্ন আয়ের জনগণের জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। নিরাপদ পানির অভাবে রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।
এমন পরিস্থিতিতে, সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং পানির ব্যবস্থাপনায় নতুন প্রযুক্তি ও ধারণার ব্যবহার নিশ্চিত করা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেখা দেওয়া সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সমাজের সকল স্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তবে আমরা ঢাকা শহরের পানির সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব এবং একটি সুস্থ ও নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করতে সক্ষম হব।
সমাধানের পথ-
ঢাকার পানির সংকটের সমাধান করা সময়ের দাবি। এর জন্য সমন্বিত, সুপরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। পানি সংকট নিরসনে একটি কার্যকর উপায় হলো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। রেনওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেমের মাধ্যমে ভবনগুলোতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো সম্ভব হবে এবং প্রাকৃতিক উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা যায়।
ভূগর্ভস্থ পানি স্তর পুনরুদ্ধার করতে শহরের জলাশয়গুলো পুনঃখনন এবং সংরক্ষণ করা উচিত। পুরনো পুকুর, খাল এবং জলাধারগুলো পুনরায় খনন করা হলে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারবে, যা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের মতো প্রধান নদীগুলোর পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কলকারখানা থেকে বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে হবে। নদীগুলোর পানির গুণমান উন্নত করতে পরিকল্পিতভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে, এসব নদী থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
ওয়াসার পানির পরিশোধন ও সরবরাহ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পানির অপচয় রোধ এবং সরবরাহ লাইনের লিকেজ বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি নতুন পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন এবং বিদ্যমান প্ল্যান্টগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।
পানি পরিশোধন এবং পুনঃব্যবহারে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে। লবণাক্ত পানি মিষ্টি পানি করার ডেস্যালিনেশন প্রযুক্তি (ডেসালিনেশন প্রযুক্তি হলো একটি প্রক্রিয়া যা সমুদ্র বা লবণাক্ত পানিকে বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তরিত করে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে লবণাক্ত পানির অণুগুলোকে আলাদা করা হয় যাতে করে সুপেয় পানির যোগান দেওয়া যায়), সোলার ওয়াটার ডিস্টিলেশন এবং পানি পুনর্ব্যবহারের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঢাকার পানি সংকটকে আরও প্রকট করে তুলেছে। বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাওয়া, শুষ্ক মৌসুম দীর্ঘ হওয়া এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পানির চাহিদা আরও বেড়েছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ঢাকার পানি সংকট সমাধানে শুধু স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগই নয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও অপরিহার্য। নগরীর পানির সমস্যা সমাধানে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ-
প্রথমত, জলাদার সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। শহরের বিভিন্ন জলাধার, যেমন নদী, খাল এবং পুকুরগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা জরুরি। এই জলাধারগুলোর মাধ্যমে বর্ষার পানি ধরে রেখে মাটির পানির স্তর বাড়ানো সম্ভব। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে হবে। অতিরিক্ত উত্তোলনের ফলে যে সংকট তৈরি হচ্ছে, তার সমাধানে কৃত্রিম পানি মজুদ ও রিচার্জিং পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে, বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য ছাদ থেকে পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হতে পারে।
আবার, পানির উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং নিয়মনীতি বাস্তবায়নও অত্যাবশ্যক। পানি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত, যাতে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি পায়।
এজন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ পানি সংকট সমাধানে জনগণের ও দায়িত্ব রয়েছে। পানির অপচয় রোধ করতে হবে। পানির সঠিক ব্যবহার এবং সংরক্ষণের বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন কর্মসূচি চালু করতে হবে। পানি সংকট সমাধানে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। পানি পরিশোধনের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। এটি শুধু পানির গুণগত মান উন্নত করবে না বরং পানি সংকটের সমাধানেও সহায়ক হবে।
এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ঢাকা শহরের পানি সংকটের সমাধানে একটি স্থায়ী ভিত্তি তৈরি করা সম্ভব। একসঙ্গে কাজ করলে, আমরা একটি সুস্থ ও নিরাপদ পানির পরিবেশ তৈরি করতে পারব।বিশেষ করে নগর পরিকল্পনা, পানি ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকার জলাধার সংরক্ষণ, খাল পুনরুদ্ধার এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করলে শহরের পানির সংকট দীর্ঘমেয়াদে কমানো সম্ভব।
শেষে বলতেই হয়, পানি সংকট কেবল ঢাকার একটি সমস্যা নয়; এটি একটি জাতীয় সমস্যা। যদিও ঢাকার পানি সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে এর সমাধান আমাদের হাতেই। সংকট যত সময় যাচ্ছে ততই বেড়ে চলছে এবং ঢাকাবাসী এমনকি সারা বাংলাদেশের নাগরিকদের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এর সংকটের তীব্রতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে এখনই সময় এ সমস্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত হওয়া। এ পর্যন্ত বিভিন্ন পানি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য পানি সম্পদ বোর্ড, ওয়াসা ইত্যাদি কর্তৃপক্ষ থাকলেও তাদের সঠিক মনোযোগ ও উৎসাহের অভাবের কারণে এর সমস্যাটি অবহেলার মধ্যে পড়েছিল। কিন্তু প্রতিটি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি টেকসই সমাধান বের করা সম্ভব। যদি আমরা আজ থেকেই উদ্যোগ না নিই, তবে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও গুরুতর হতে পারে।