বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংকটের প্রেক্ষাপটে অক্সিজেন উৎপাদন এখন একটি অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অক্সিজেন সংকট কতটা ভয়াবহ হতে পারে।
বিশেষতঃ আমাদের মতো দেশগুলোতে যেখানে উন্নত প্রযুক্তি ও অর্থায়নের অভাব প্রকট। এই প্রেক্ষাপটে কম খরচে অক্সিজেন উৎপাদনের নতুন ধারণা ও উদ্ভাবন আমাদের জন্য একটি আশার আলো নিয়ে এসেছে। উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহারে খরচ কমিয়ে অক্সিজেন উৎপাদন সম্ভব হলে শুধু জীবন রক্ষা নয় বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও এটি এক বিরাট সাফল্য হিসেবে পরিগণিত হবে।
অক্সিজেন উৎপাদনের বর্তমান পদ্ধতি-
বর্তমানে অক্সিজেন উৎপাদনের প্রধান পদ্ধতি হিসেবে এয়ার সেপারেশন ইউনিট (ASU) এবং লিকুইফাইড অক্সিজেন উল্লেখযোগ্য। ASU একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি, যা বায়ু থেকে অক্সিজেন আলাদা করে। তবে, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য এটি একটি সীমাবদ্ধতা। অন্যদিকে, লিকুইফাইড অক্সিজেন উৎপাদনের প্রক্রিয়া জটিল এবং ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় না। এই অবস্থায় কম খরচে অক্সিজেন উৎপাদনের নতুন উপায় উদ্ভাবন করা অত্যন্ত জরুরি।
নতুন উদ্ভাবন ও ধারণা-
অক্সিজেন উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তিগুলোর উদ্ভাবন আমাদের সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। ন্যানোপোর্টেবল অক্সিজেন জেনারেটর হল একটি উদাহরণ। এটি ছোট আকারের, শক্তি সঞ্চয়কারী এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি, যা গ্রামীণ এলাকায় সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই যন্ত্রগুলি বাতাস থেকে অক্সিজেন বের করার জন্য অত্যন্ত কার্যকর।
মাইক্রোবায়াল প্রযুক্তি আরেকটি নতুন উদ্ভাবন। যেখানে কিছু ব্যাকটেরিয়া, যেমন: Cyanobacteria, ফটোসিন্থেসিসের মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এই প্রযুক্তি পরিবেশের জন্য লাভজনক, কারণ এটি বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড কমাতে সহায়তা করে এবং অক্সিজেনের যোগান বাড়ায়।
অন্যদিকে, কৃত্রিম বায়োসিন্থেসিস হল একটি নতুন ও উদ্ভাবনী পদ্ধতি। যা সূর্যরশ্মি, পানি এবং CO2 ব্যবহার করে অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এটি পরিবেশবান্ধব এবং খরচেও সাশ্রয়ী। এছাড়াও, গবেষকরা জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত অণুজীব তৈরি করছেন, যা অক্সিজেন উৎপাদনে দক্ষতা বাড়াতে সক্ষম।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা-
নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ- নতুন প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং গবেষণা করতে হবে। সেই সঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি। তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অক্সিজেন উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির সম্ভাবনা অসীম। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই প্রযুক্তি কৃষি, শিল্প এবং স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা-
বাংলাদেশ সরকারের এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উচিত একত্রিত হয়ে অক্সিজেন উৎপাদনের নতুন প্রযুক্তি বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা। সরকারি এবং বেসরকারি খাতের সহযোগিতায় গবেষণার মান উন্নত করা এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব। এতে করে আমরা সহজে সাশ্রয়ী মূল্যে অক্সিজেন উৎপাদনের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারব।
অক্সিজেন উৎপাদনের খরচ কমানোর জন্য নতুন ধারণা ও উদ্ভাবনগুলোকে সমর্থন করা অপরিহার্য। যদি আমরা সফলভাবে এসব প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারি, তবে তা দেশের অর্থনীতি এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সুযোগ, যেখানে কম খরচে অক্সিজেন উৎপাদন করে একটি স্বাস্থ্যকর এবং উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব। আশা করা যায়, বাংলাদেশ অক্সিজেন উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি সফল মডেল হবে, যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করবে। এভাবে, নতুন প্রযুক্তি ও ধারণার মাধ্যমে অক্সিজেন উৎপাদনকে সাশ্রয়ী ও কার্যকর করে তুলতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।