বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অমূল্য অংশ। যা কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বরং আমাদের সমাজের নৈতিক ও সৃজনশীলতার প্রতিফলন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আধুনিক জীবনযাত্রার প্রভাব ও নগরায়ণের অস্থিরতা আমাদের এই ঐতিহ্যকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের অতীতের নিদর্শনগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূল নিদর্শন যেমন পুরানো স্থাপত্য, গ্রামীণ সংস্কৃতি, লোকসঙ্গীত, এবং প্রাচীন শিল্পকলার নানা ধরণ ইত্যাদি নিঃসন্দেহে আমাদের গর্বের বিষয়। আমাদের জাদুঘর বা ঐতিহাসিক স্থানগুলোতেই আমাদের পূর্বপুরুষদের সৃষ্টির নিদর্শন ও বাঙালির সমৃদ্ধ ইতিহাস লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র, কুঠিবাড়ি ও পানাম নগরী আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এইসব স্থান শুধু স্থাপত্যের জন্যই নয় বরং আমাদের সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ।
কিন্তু শহরায়ণ এবং আধুনিক উন্নয়নের নামে আমাদের এই মূল্যবান ও সমৃদ্ধ অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ধ্বংস করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো আজ বিপন্ন। লালবাগ কেল্লার মতো মুঘল স্থাপত্য যা একসময় গৌরবের প্রতীক ছিল, এখন চরম অবহেলার শিকার। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং পরিবেশ দূষণে এর নান্দনিকতা হারিয়ে যাচ্ছে, ভাঙনের মুখে পড়েছে কেল্লার দেয়াল। পানাম নগরের ইতিহাসও একসময় জীবন্ত ছিল কিন্তু এখন শুধুই ভগ্নপ্রায় দালানের স্তূপ। চন্দ্রিমা উদ্যানের মতো ঐতিহাসিক স্থানগুলোও ক্রমশ দখল এবং বাণিজ্যিকীকরণের শিকার হচ্ছে। শুধু স্থাপত্য নয়, যেসব ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে, সেগুলোরও সঠিক যত্নের অভাব দেখা দিয়েছে। সেগুলো অনেকাংশেই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ম্লান হয়ে যাচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে ঐতিহাসিক দলিল এবং শিল্পকর্মের মূল্যবান নমুনা। টেম্পারেচার এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে না থাকায় জাদুঘরের অনেক মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু ধ্বংসের পথে। আমাদের জাতীয় জাদুঘরের নিদর্শনগুলো এবং গুপ্ত নিদর্শন গুলো (যেগুলো সাধারণের প্রদর্শনের জন্য রাখা হয় না ) যেগুলোর সংখ্যা প্রায় অর্ধলক্ষাধিক সেগুলোও যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সংকটে রয়েছে।আমাদের গৌরবময় অতীতের সাথে যুক্ত এসব নিদর্শন এখন হারানোর পথে, যা আমাদের ঐতিহ্যকে সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনা যেমন আহসান মঞ্জিল এবং ষাট গম্বুজ মসজিদও একইভাবে সংকটের মুখে। আহসান মঞ্জিল, একসময় ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ, এখন পরিবেশ দূষণ ও অবহেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ষাট গম্বুজ মসজিদ, যা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, সঠিক সংরক্ষণের অভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। একইভাবে ময়মনসিংহের প্রাচীন জমিদার বাড়িগুলো ধ্বংসের পথে, যেখানে একসময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল শৌর্যবীর্যপূর্ণ স্থাপত্যকলা। এছাড়া পুরনো বাড়ি, মন্দির এবং ধর্মীয় স্থানগুলো নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ভাঙা হচ্ছে। এর ফলে বাঙালি হারাচ্ছে তাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা প্রতিটি ভাঙা দেয়ালে রয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের গল্প, যা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না।এছাড়া বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রাচুর্য, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে এইসব ঐতিহ্য বেশিরভাগই অপরিচিত হয়ে পড়ছে। তারা আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং নিজেদের দেশের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ- দেশি লোকগান ও নৃত্যের পরিবর্তে বিদেশি বিশেষত পশ্চিমা মিউজিক ও নাচের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়ায় সরকার, সমাজ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সকলের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সরকারী উদ্যোগে ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে সংরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা উচিত। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী শিল্প ও সংস্কৃতিকে নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কুলে ও কলেজে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের আয়োজন করা উচিত যাতে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সংস্কৃতির চর্চা ও প্রচারে ভূমিকা পালন করতে হবে। সাংস্কৃতিক সপ্তাহের আয়োজন, লোকসঙ্গীত ও নৃত্য কর্মশালা এবং ঐতিহাসিক স্থানের ভ্রমণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা যেতে পারে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা জরুরি।এছাড়া সমাজের সকল স্তরে সাংস্কৃতিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটি কেন্দ্রগুলোতে ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান এবং উৎসব আয়োজন করা যেতে পারে। যেখানে সমাজের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করে নিজেদের সংস্কৃতি উদযাপন করবে।
বর্তমানে এ বিষয়টি নিশ্চিত যে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির প্রতিই মূল্যায়ন কমে যাচ্ছে। কিন্তু বাঙালি নিজেই যদি তাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যের প্রতি সচেতন না হয়, তাহলে একদিন তারা তাদের সমৃদ্ধ ও গর্বিত জাতিগত পরিচয় হারিয়ে ফেলবে। তাই আমাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব বোঝা ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। মূলত বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একটি গভীর সমুদ্রের মতো। এর গভীরতায় রয়েছে আমাদের ইতিহাসের অসংখ্য রঙ, সুর ও গল্প। আমাদের দায়িত্ব হল এই সমুদ্র থেকে মূল্যবান রত্নগুলোকে রক্ষা করা এবং আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। অতীতের নিদর্শনগুলো আমাদের ইতিহাসের সাক্ষী ও আমাদের পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু।
সুতরাং, আমরা যদি চাই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঁচুক- তবে আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় অতীতের অংশীদার হতে পারে। আমাদের ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা জানতে পারে তারা কোন সংস্কৃতির সন্তান এবং তাদের পূর্বপুরুষদের অবদান কী ছিল।সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণ আমাদের সকলের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কোনো মতেই আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও ধানগুলোর প্রতি অবহেলা করা যাবে না, কেননা এগুলো অন্য কোনো দেশ বা জাতির ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনের চেয়ে কম নয়। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে আমরা আমাদের অতীতের নিদর্শনগুলোকে রক্ষা করতে পারি এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারি।