রাজস্ব আহরণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়া, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের পরিমাণ কমে যাওয়া এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) থেকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাতিল করার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য বাজেটের আকার কমিয়ে আনছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরের বাজেটের মোট ব্যয় ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর এই প্রথমবার আগের বছরের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার ছোট হতে চলেছে।
মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার সংক্রান্ত সমন্বয় পরিষদের (কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল) বৈঠকে এই বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন অর্থবিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা জানান, বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য ও বাস্তবতানির্ভর করতে গিয়েই আকার হ্রাসের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অর্থবিভাগ জানিয়েছে, বাজেটের এই সংক্ষিপ্তকরণ মূলত উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা যা চলতি বছরের এডিপি বরাদ্দ ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার চেয়ে ৩৫ হাজার কোটি টাকা কম। এই খাতেই মূলত বাজেট হ্রাসের প্রভাব পড়বে।
সরকারের ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেওয়া বেশিরভাগ মেগা প্রকল্প ইতোমধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছে। তাছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে কোনো মেগা প্রকল্প গ্রহণ না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া আগের সরকারের রাজনৈতিক বিবেচনায় গৃহীত কিছু প্রকল্প বাতিল করায় উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কমে এসেছে। ফলে খরচও কমেছে।
যদিও সামগ্রিক বাজেটের আকার কমছে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা বরং বাড়ানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে এনবিআরের জন্য রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। যদিও এনবিআর এই পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে ৫ লাখ কোটি টাকার মধ্যে সীমিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা যা বাস্তবায়নে ঘাটতির মুখে পড়ে পরবর্তীতে সংশোধিত বাজেটে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে আনা হয়।
আগামী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থবিভাগ জানিয়েছে, উচ্চ সুদের কারণে অভ্যন্তরীণ ঋণ গ্রহণ কমিয়ে আনতেই ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা তুলনামূলকভাবে সীমিত রাখা হয়েছে। প্রস্তাবিত ঘাটতির অর্ধেকেরও বেশি মেটানো হবে বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া ঋণ দিয়ে। বাকিটা সরকার পূরণ করবে ব্যাংক খাত এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে।
নতুন বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রেও কিছুটা সংযত পূর্বাভাস দিচ্ছে সরকার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা করছে অর্থবিভাগ। তুলনায় চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ৬.৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ। তবে বাস্তবায়ন চিত্র ভিন্ন—সংশোধিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি ৮.৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
সব মিলিয়ে অর্থবিভাগের এই বাজেট পরিকল্পনায় দেখা যাচ্ছে— বাজেটের বাস্তবায়নযোগ্যতা, উন্নয়ন ব্যয়ের দক্ষতা এবং ঘাটতির ভারসাম্য রক্ষায় নতুন অর্থবছরকে প্রস্তুত করতে চায় সরকার। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে এবং রাজস্ব আহরণের ওপর জোর দিয়েই এই বাজেট কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।