আপনার বিলাসবহুল গাড়ি, বড় বাড়ি বা বিপুল সম্পদ থাকলেও ব্যাংকের চোখে আপনি একজন সাধারণ গ্রাহক যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি ব্যাংকে উচ্চমাত্রার লেনদেন ও সঞ্চয়ের রেকর্ড গড়ছেন। তবে একবার যদি আপনি এই উচ্চমানের গ্রাহকের তালিকায় ঢুকে পড়েন তাহলেই বদলে যেতে শুরু করে চিত্র। তখন ব্যাংকে লাইন ধরার প্রয়োজন নেই কল সেন্টারে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার বালাইও নেই। আপনাকে সেবা দিতে থাকবে ব্যাংকের নির্ধারিত রিলেশনশিপ ম্যানেজার (আরএম)। প্রয়োজনে সেবা পৌঁছে যাবে আপনার বাড়ির দরজায়ও। শুধু তাই নয় উৎসব কিংবা জন্মদিনেও ব্যাংক থাকবে আপনার পরিবারের পাশে উপহার নিয়ে পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে।
একসময় এই সেবা শুধু উচ্চবিত্তদের জন্য সীমাবদ্ধ থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মধ্যবিত্ত এবং তুলনামূলক উচ্চ আয়ের গ্রাহকেরাও এখন এই সেবার দিকে ঝুঁকছেন। এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে একটি নতুন সামাজিক শ্রেণি যাঁরা শুধু ব্যাংকিং সেবা নয় সামাজিক যোগাযোগ ও একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগও পাচ্ছেন। অনেকে আবার এই শ্রেণির গ্রাহকদের নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিজেদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছেন।
বর্তমানে দেশে এক লাখের বেশি গ্রাহক এই ‘অগ্রাধিকার ব্যাংকিং’ সেবার আওতায় আছেন। তাঁদের আমানতের পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই সংখ্যা ও জমা উভয়ই দিন দিন বাড়ছে। ফলে ব্যাংকগুলোও এই সেবা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে উন্নত করছে তাদের সেবার মান।
বাংলাদেশে প্রথম অগ্রাধিকার ব্যাংকিং সেবা চালু করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ১৯৯৯ সালে। এরপর ২০০৯ সালে ইস্টার্ন ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি দেশীয় ব্যাংক এই সেবা চালু করে। বর্তমানে ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইউসিবি, প্রাইম ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে এই সেবা চালু রয়েছে। প্রতিযোগিতার ফলে গ্রাহকেরাও পাচ্ছেন বাড়তি সুবিধা।
আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই সেবা অনেক পুরোনো। সেখানে অগ্রাধিকার গ্রাহকদের জন্য থাকে সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিনিয়োগ পরামর্শ, ব্যক্তিগত ব্যাংকিংসহ নানা সুবিধা। তবে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এখনো কেবল ব্যাংকিং সেবা কেন্দ্রিক সুবিধায় সীমাবদ্ধ। তবুও এর মধ্য দিয়েই বিশেষ শ্রেণির গ্রাহকদের জন্য জীবনযাত্রা সহজতর করা হচ্ছে।
এই গ্রাহকদের জন্য নির্ধারিত চেক বই ও কার্ড থাকে আলাদা ধরনের। ব্যাংকের শাখায় গিয়ে তাঁদের অপেক্ষা করতে হয় না নির্দিষ্ট কর্মকর্তার মাধ্যমেই দ্রুত সেবা পান। কল সেন্টারে সংযোগের অপেক্ষাও করতে হয় না সরাসরি সংযোগ পান। শুধু আর্থিক সেবা নয় উৎসব বা বিশেষ দিবসে উপহার পাঠানো, জন্মদিনে কেক পৌঁছে দেওয়া, বিমানবন্দরের লাউঞ্জ ও গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ, তারকা হোটেলে বিনামূল্যে ডিনার এবং হাসপাতালে বার্ষিক স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন তাঁরা।
১৯৯৯ সালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে তৎকালীন এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংক এই সেবার সূচনা করে। ২০০১ সালে ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। গুলশান, নাসিরাবাদ ও উত্তরায় পর্যায়ক্রমে তিনটি অগ্রাধিকার সেবাকেন্দ্র চালু করে তারা। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ছয়টি অগ্রাধিকার সেন্টার রয়েছে। ৩৫ লাখ টাকা জমা রাখলেই গ্রাহক এই সেবার আওতায় আসতে পারেন।
ইস্টার্ন ব্যাংক ২০০৯ সালে তাদের অগ্রাধিকার সেবা চালু করে। এখন দেশে তাদের ২৩টি শাখায় এই সেবা চালু রয়েছে। সেখানে কাজ করছে একটি নিবেদিত কর্মীবাহিনী। ৫০ লাখ টাকা জমা থাকলেই এই সেবা পাওয়া যায়। ব্যাংকটির প্রায় ১০ হাজার ৫০০ গ্রাহক প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জমা রেখেছেন। বেশিরভাগ গ্রাহকই ব্যবসায়ী, ভূস্বামী কিংবা উচ্চ বেতনের চাকরিজীবী। তানজেরী হক, ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রায়োরিটি অ্যান্ড উইমেন ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান, জানান—তাঁদের সেবা এখন আলাদা পরিচিতি পেয়েছে এবং গত দুই বছরে গ্রাহক ও আমানত দ্বিগুণ হয়েছে।
ব্র্যাক ব্যাংকও ২০০৯ সালে ‘প্রিমিয়াম ব্যাংকিং’ নামে এই সেবা চালু করে। তাদের ২৪টি শাখায় এ সেবা চালু রয়েছে। ৩০ লাখ টাকা জমা রাখলেই গ্রাহক এই সেবার আওতায় আসেন। বর্তমানে ১৫ হাজার গ্রাহক এই সেবায় যুক্ত আছেন এবং তাঁদের জমার পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। গত এক বছরে গ্রাহক সংখ্যা ৬০ শতাংশ এবং আমানত ৭০ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ঢাকার বাইরের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে এই সেবা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এবং নিবেদিত কর্মীদের ভবিষ্যতে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় পরামর্শক হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
২০১৩ সালে সিটি ব্যাংক শাখার বাইরে পৃথক সেন্টার হিসেবে ‘সিটিজেম’ চালু করে। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সাতটি সেন্টারে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে। ৭৫ লাখ টাকা জমা রাখলেই এই সেবার আওতায় আসা যায়। গ্রাহকদের জন্য রয়েছে রূপচর্চা, শরীরচর্চা, কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া ও ভ্রমণে ছাড়ের ব্যবস্থা। বর্তমানে সিটি ব্যাংকের এই সেবায় রয়েছে ২৯ হাজার ৬৪১ জন গ্রাহক, যাঁদের জমা ১৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা। গত বছরে এ সেবার আমানত দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক অরূপ হায়দার বলেন, সিটিজেম কেন্দ্রের মাধ্যমে গ্রাহকদের জীবনযাত্রা সহজ করে তোলার কাজ চলছে এবং বিশেষ গ্রাহকদের জন্য সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করাই তাঁদের লক্ষ্য।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ২০১০ সালে ‘প্রিভিলেজ ব্যাংকিং’ চালু করে। বর্তমানে তাদের ছয়টি কেন্দ্রে এই সেবা দেওয়া হয়। ৪০ লাখ টাকা জমা রাখলেই এ সেবা পাওয়া যায়। ব্যাংকটির ২ হাজার ২০০ জন গ্রাহকের জমা রয়েছে ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ২০১২ সালে ‘ইম্পেরিয়াল’ নামে সেবা চালু করে। ২৫ লাখ টাকা জমা থাকলেই এই সেবা গ্রহণযোগ্য হয়। বর্তমানে এই সেবার গ্রাহক ১৭ হাজার ৮৪০ জন এবং তাঁদের মোট আমানত ৬ হাজার কোটি টাকা। ১৩টি কেন্দ্রে এ সেবা চালু রয়েছে। গ্রাহকদের জন্য বিমানবন্দরে লাউঞ্জ ব্যবহারের সুবিধাও দেওয়া হয়।
প্রাইম ব্যাংক ২০১৪ সালে ‘মোনার্ক’ নামে অগ্রাধিকার ব্যাংকিং সেবা চালু করে। ২০ লাখ টাকা জমা থাকলেই গ্রাহক হতে পারেন। বর্তমানে প্রায় সাড়ে সাত হাজার গ্রাহক এই সেবার আওতায় এবং তাঁদের জমা ৫ হাজার কোটি টাকা। নয়টি কেন্দ্রে সেবা দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া ডাচ্–বাংলা ব্যাংক ‘ভিআইপি ব্যাংকিং’, বহুজাতিক এইচএসবিসি ‘সিলেক্ট ব্যাংকিং’ এবং স্থানীয় মধুমতি, মেঘনাসহ আরও কিছু ব্যাংক বিভিন্ন নামে এই সেবা চালু করেছে।
অগ্রাধিকার ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, গ্রাহকেরা বাড়তি গুরুত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই সেবার দিকে ঝুঁকছেন। এতে করে ব্যাংকে উচ্চ পরিমাণে আমানত জমা হচ্ছে যা ব্যাংকের তহবিল খরচ কমায় এবং একই সঙ্গে একটি আলাদা ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করে। ফলে নতুন নতুন ব্যাংক এই সেবা চালু করছে এবং যারা ইতিমধ্যে চালু করেছে তারা নিয়মিত নতুন নতুন সুবিধা যোগ করছে।
এইসব পদক্ষেপে দেশের ব্যাংকিং খাত ধীরে ধীরে এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে যেখানে শুধু টাকা রাখা বা উত্তোলন নয় বরং একজন গ্রাহকের সম্পূর্ণ জীবনধারার অংশ হয়ে উঠছে ব্যাংক।