আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠকে বিনিময় হারের নমনীয়তা নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সোমবার (৫ মে) সন্ধ্যায় জুম প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, ডেপুটি গভর্নর মো. হাবিবুর রহমান ও কবির আহম্মদ।
সূত্রমতে, আলোচনায় কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসায় বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী বৈঠকের প্রস্তুতি নেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে বিনিময় হারের নমনীয়তা বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটানো হচ্ছে। তবুও সোমবারের বৈঠকে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলেও মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর আগে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও সেখানেও কোনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। সেই অচলাবস্থা কাটাতে ৫ মে’র বৈঠকটি আয়োজন করা হয়।
মূলত নমনীয় মুদ্রা বিনিময় হার বাস্তবায়নের শর্ত ঘিরেই আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণ কার্যক্রমে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এই জটিলতার ফলে এখন পর্যন্ত আটকে আছে ১৩০ কোটি ডলারের ঋণ কিস্তি। উল্লেখ্য আইএমএফের সঙ্গে বাংলাদেশের পুরো ঋণচুক্তির পরিমাণ ৪৭০ কোটি ডলার।
আইএমএফ চায় বাংলাদেশ পুরোপুরি ‘ফ্রি ফ্লোটিং’ বা বাজার-নির্ধারিত বিনিময় হার চালু করুক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। ওয়াশিংটনের বৈঠকেও গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আইএমএফের এই শর্ত মেনে নিতে রাজি হননি।
বর্তমানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ২১ বিলিয়ন ডলার যা দিয়ে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তবে আইএমএফ এই রিজার্ভ থেকে কিছু দায় বাদ দিয়ে ‘নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ’ (এনআইআর) হিসাব করে যা তাদের মূল্যায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে আইএমএফের প্রতিনিধি দলকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রস্তাব দেয়, এনআইআর ফ্লোর বাতিল করে একটি তহবিল গঠন করতে চায় তারা যার মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার বাজারে ছাড়া যাবে। যদিও এখনো আইএমএফ এ বিষয়ে কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, চলতি বছরের জুন নাগাদ বিষয়টি নিয়ে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, হঠাৎ করে পুরোপুরি ফ্রি ফ্লোটিং বিনিময় হার চালু করা হলে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। কিছু ডলার এগ্রিগেটর তখন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে মুদ্রা বিক্রি করতে পারে। তার মতে, দেশের মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চমাত্রায় রয়েছে এবং এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, “যদি আমরা একটি প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল গঠন করতে পারি, তাহলে বাজারে প্রয়োজনমতো ডলার সরবরাহ করে কারসাজি ঠেকানো যাবে।” তিনি ভারতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “পুঁজির বহির্গমন বা বাণিজ্যিক অনিশ্চয়তার সময় রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া নিয়মিত হস্তক্ষেপ করে রুপির দর স্থিতিশীল রাখে। বাংলাদেশেও একই কৌশল গ্রহণ করলে সুফল মিলতে পারে।”
তিনি আরও জানান, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক খোলা বাজার এড়িয়ে কাতার থেকে জ্বালানি আমদানির অর্থ সরাসরি পরিশোধ করেছে। এর ফলে যারা ডলার মজুত করেছিল তারা বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করে। ফলে বাজারে ডলারের বিনিময় হার ৫০ থেকে ৬০ পয়সা কমে আসে।
এদিকে আইএমএফের অতিরিক্ত শর্ত আরোপের বিষয়ে সরকারের অবস্থানও স্পষ্ট করেছে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। গত শনিবার তিনি বলেন, “আইএমএফ যদি অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করে তবে বাংলাদেশ আর এ ঋণ নিতে আগ্রহী থাকবে না। কারণ সব শর্ত মানলে দেশের অর্থনীতি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।”
সব মিলিয়ে বিনিময় হার ও ঋণ কার্যক্রম নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফের মধ্যকার মতপার্থক্য এখনো নিরসন হয়নি। তবে দুই পক্ষই আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানের দিকে এগোতে আগ্রহী। জুনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।