চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি–মার্চ) ব্যবসার দিক থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার পেছনে ফেলেছে বহুজাতিক কোম্পানি বাটা শুকে। তবে আয় বেশি হলেও মুনাফার দিক থেকে এখনো শীর্ষে রয়েছে বাটা। এই সময়কালে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার ৫৪০ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করলেও তাদের মুনাফা হয়েছে মাত্র ৯৭ লাখ টাকা। বিপরীতে বাটা শু ৩৫৮ কোটি টাকার ব্যবসা করে আয় করেছে ৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যবসায় অ্যাপেক্স বাটাকে ছাড়িয়ে গেলেও মুনাফায় ৩৬ কোটি টাকার ব্যবধানে পিছিয়ে পড়েছে দেশীয় এই প্রতিষ্ঠান।
বাটা ও অ্যাপেক্সের এ বৈষম্যের মূল কারণ দুটি। প্রথমত অ্যাপেক্সের উৎপাদন খরচ বাটার তুলনায় অনেক বেশি। দ্বিতীয়ত, ব্যাংকঋণের সুদ বাবদ খরচও বাটার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে অ্যাপেক্সের। কোম্পানি দুটির চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্প্রতি দুটি কোম্পানি তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাটা শুর ৩৫৮ কোটি টাকার আয়ের বিপরীতে পণ্য উৎপাদনের খরচ ছিল ১৯৫ কোটি টাকা, যা মোট আয়ের ৫৪ শতাংশ। অন্যদিকে, অ্যাপেক্সের ৫৪০ কোটি টাকার আয়ের বিপরীতে উৎপাদন খরচ হয়েছে ৪১৪ কোটি টাকা অর্থাৎ আয়ের প্রায় ৭৭ শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী, ১০০ টাকা আয় করতে বাটার খরচ হয়েছে ৫৪ টাকা, যেখানে অ্যাপেক্সের ক্ষেত্রে সেই খরচ ৭৭ টাকা। ফলে ব্যবসা ভালো করলেও উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের কারণে মুনাফা কমেছে অ্যাপেক্সের।
সুদ খরচেও দেখা যায় উল্লেখযোগ্য পার্থক্য। জানুয়ারি–মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংকঋণের সুদ বাবদ বাটা শু খরচ করেছে প্রায় ৬ কোটি টাকা, আর একই সময়ে অ্যাপেক্সের সুদ খরচ দাঁড়িয়েছে ১৫ কোটি টাকায়। এতে মুনাফায় আরও পিছিয়ে পড়েছে অ্যাপেক্স।
এই ব্যয়-বৈষম্যের বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) দিলীপ কাজুরি বলেন, “বাটার তুলনায় আমাদের উৎপাদন খরচ বেশি। তারা পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয় কার্যক্রমে আউটসোর্সিংয়ের ওপর নির্ভর করে। অন্যদিকে, আমরা নিজস্ব কারখানায় জুতা তৈরি করি এবং নিজস্ব কর্মী দিয়ে আউটলেট পরিচালনা করি। গুণগত মানের বিষয়ে আমরা আপস করি না। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের বিনিময় হারসহ নানা কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে কিন্তু আমরা সেই হারে পণ্যের দাম বাড়াইনি। ফলে খরচ বেড়ে গেছে।”
জুতার বাজারে এখন অ্যাপেক্স ও বাটা শু সবচেয়ে বড় দুটি কোম্পানি। ব্যবসায় অ্যাপেক্স বহু আগেই বাটাকে ছাড়িয়ে গেলেও মুনাফার দিক থেকে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। অ্যাপেক্সের হিসাব বছর গণনা হয় জুলাই-জুন অর্থবছর হিসেবে, আর বাটা শু গণনা করে জানুয়ারি-ডিসেম্বর পঞ্জিকা বর্ষ অনুযায়ী। এ হিসাবে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে অ্যাপেক্স ১ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে যার বিপরীতে কর–পরবর্তী মুনাফা ছিল প্রায় ১৮ কোটি টাকা। একই সময়ে বাটা ২০২৩ সালে ব্যবসা করেছে ৯৮৮ কোটি টাকার এবং বছরের শেষে মুনাফা করেছে ৪০ কোটি টাকা।
এই বৈষম্য পুরো বছরের হিসাবেও স্পষ্ট। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ১০০ টাকা আয়ের বিপরীতে অ্যাপেক্সের উৎপাদন খরচ ছিল ৭০ টাকা, যেখানে বাটার উৎপাদন খরচ ছিল ৫৪ টাকা। ফলে বছরজুড়েও ৫০০ কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করেও মুনাফায় পিছিয়ে ছিল অ্যাপেক্স।
এদিকে বাটা শুর পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ঈদের কারণে বিক্রি ভালো হয়েছে। সেই সময় সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করা হয়েছে। কাঁচামাল সংগ্রহে দর-কষাকষির মাধ্যমে অনুকূল শর্ত নিশ্চিত করা হয়েছে এবং খরচ নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব কারণে প্রথম প্রান্তিকে ভালো মুনাফা করেছে কোম্পানিটি।
বাটা বাংলাদেশ আরও জানিয়েছে, তারা গত সাত বছর ধরে চামড়া ও পাদুকা খাতে সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। শুধু ২০২৪ সালেই কোম্পানিটি শুল্ক ও কর বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে ২৮১ কোটি টাকার বেশি।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ব্যবসায় এগিয়ে থাকলেও উৎপাদন ও সুদ খরচ নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারায় মুনাফার দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। বিপরীতে ব্যয় ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা দেখিয়ে তুলনামূলক কম আয়ে বড় মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে বাটা শু।