চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর। এপ্রিল পর্যন্ত প্রথম ১০ মাসে মাত্র ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সোমবার (১৯ মে) পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়নে অর্থছাড় হয়েছে ৯৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। শুধু এপ্রিল মাসেই অর্থছাড় হয়েছে ১০ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা যেখানে গত বছরের একই মাসে ছাড় হয়েছিল ১৭ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী উন্নয়ন খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা, যদিও মূল এপিপিতে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবে আরও প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা খরচ করতে হবে বাকি দুই মাসে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, যেখানে ১০ মাসে মাত্র ৯৩ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে সেখানে আগামী দুই মাসে বড়জোর আরও ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা সম্ভব হবে। ফলে বিশাল অঙ্কের অর্থছাড় অনিষ্পন্নই থেকে যাবে।
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদ জানান, অনেক প্রকল্পে কাজ শেষ হলেও বিল পরিশোধ করা হয়নি। আর্থিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে বিল যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে যার ফলে ব্যয়ের হার কম। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বছরের শেষ দিকে তাড়াহুড়ো করে খরচ বাড়ালে অপচয়, দুর্নীতি এবং ব্যয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তার মতে, উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে গুণগত মান বজায় রাখতে হলে ধৈর্য ধরে যাচাই-বাছাই করেই অর্থছাড় করা উচিত।
আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন মনে করেন, এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অর্থছাড়ের হার কমে যাওয়া। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সরকার উন্নয়ন ব্যয় সীমিত রাখার নীতি নিয়েছে ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থছাড়ে রক্ষণশীলতা দেখা যাচ্ছে। একইসঙ্গে সরকার এখন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রকৃত চাহিদা না থাকায় চলতি অর্থবছরের এডিপি থেকে ৪৯ হাজার কোটি টাকা বাজেট থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। তাছাড়া থোক বরাদ্দ হিসেবে রাখা হয়েছে ২৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা, যদিও বাস্তবে কখনোই এই থোক বরাদ্দের পুরো অর্থ খরচ হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের প্রকৃত এডিপি বাস্তবায়ন মূল লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় এক লাখ কোটি টাকা কম হবে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, যার পরিমাণ ১৯ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ ব্যয় করেছে ১৫ হাজার ২৭০ কোটি টাকা এবং সড়ক-মহাসড়ক বিভাগ ব্যয় করেছে ৮ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, যেখানে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৫৩ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ব্যয় করেছে ৮৪৫ কোটি টাকা।
এডিপি বাস্তবায়নে এমন ধীরগতি নিয়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি সরকারি পর্যায়ের অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অক্ষমতা না শুধু আর্থিক পরিকল্পনার ব্যর্থতা তুলে ধরে বরং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। উন্নয়ন ব্যয়ের গুণগতমান বজায় রেখে প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনস্বার্থে ফলপ্রসূ অগ্রগতি নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকদের প্রধান লক্ষ্য।